মো. আবদুল মজিদ মোল্লা
‘কোরবানি’ অর্থ—নৈকট্য, সান্নিধ্য, উৎসর্গ। ঈদুল আজহার দিনগুলোতে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট পশু জবাই করাকে ‘কোরবানি’ বলা হয়। (মাজমাউল আনহুর : ২/৫১৬)
কোরবানির বিধান আদম (আ.)-এর যুগ থেকেই চলে এসেছে। তবে বর্তমানে প্রচলিত কোরবানির গোড়াপত্তন করেন ইবরাহিম (আ.)। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তার (ইসমাঈলের) পরিবর্তে জবাই করার জন্য দিলাম এক মহান জন্তু। আর আমি এ বিষয়টি পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিয়েছি।’ (সুরা : সাফফাত, আয়াত : ১০৭-১০৮)
কার ওপর কোরবানি ওয়াজিব : প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্কসম্পন্ন, মুকিম, মুসলিম নর-নারী ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের ভেতর নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। (আল মুহিতুল বুরহানি : ৬/৮৫)
কোরবানির নিসাব : সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি রুপা বা প্রয়োজন অতিরিক্ত আসবাবপত্র, যার মূল্য সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার সমপরিমাণ, তা কোরবানির নিসাব।
নিসাবের মালিক নয়, এমন ব্যক্তির জন্য কোরবানি করা মুস্তাহাব। তবে তিনি কোরবানির নিয়তে কোনো পশু ক্রয় করলে তা কোরবানি করা ওয়াজিব হয়ে যায়। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/১৯২)
পৃথিবীর প্রধান প্রধান প্রায় সব ধর্মে স্রষ্টার উদ্দেশ্যে পশু উৎসর্গের বিষয়টি স্বীকৃত। বিশেষত সব আসমানি ধর্মে পশু কোরবানিকে ইবাদতের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে; যদিও ধর্মগুলোর পশু উৎসর্গ ও কোরবানি করার পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন। পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে কোরবানির আলোচনা এসেছে। সেসব আয়াতে কোরবানির সূচনা, পদ্ধতি ও পুরস্কার বিষয়ে নির্দেশ ও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এক. কোরবানির সূচনা : আল্লাহর জন্য পশু উৎসর্গের রীতি আদম (আ.)-এর সময় থেকে শুরু হলেও পশু কোরবানির চলমান ধারা ইবরাহিম (আ.)-এর মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর সে (ইসমাঈল) তাঁর পিতার সঙ্গে কাজ করার মতো বয়সে উপনীত হলো, তখন ইবরাহিম বলল, হে পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখি যে, আমি তোমাকে জবাই করছি। এখন তোমার কী অভিমত বলো? সে বলল, হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন, তা-ই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইবরাহিম তার ছেলেকে কাত করে শোয়াল তখন আমি তাকে আহ্বান করে বললাম, হে ইবরাহিম! তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যই পালন করলে!—এইভাবে আমি সৎকর্মপরায়ণদের পুরস্কৃত করি। নিশ্চয়ই এটা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে মুক্ত করলাম এক কোরবানির বিনিময়ে। আমি তা পরবর্তীদের স্মরণে রেখেছি। ইবরাহিমের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক।’ (সুরা : সাফফাত, আয়াত : ১০২-১০৯)
দুই. সব জাতির জন্য কোরবানি : পৃথিবীর সব জাতির জন্য কোরবানি আবশ্যক ছিল। বহু বিবর্তন ও রূপান্তরের পরও সব আসমানি ধর্মে কোরবানি ইবাদত হিসেবে স্বীকৃত। আল্লাহ বলেন, ‘আমি সব সম্প্রদায়ের জন্য কোরবানির নিয়ম করে দিয়েছি। তিনি তাদের জীবনোপকরণস্বরূপ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দান করেছেন, সেগুলোর ওপর যেন আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৩৪)
তিন. মুসলিম জাতির জন্য কোরবানি : আল্লাহ মুসলিম জাতির জন্য কোরবানি ওয়াজিব করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমি অবশ্যই আপনাকে কাউসার দান করেছি। সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামাজ আদায় করুন এবং কোরবানি করুন। নিশ্চয়ই আপনার প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী নির্বংশ।’ (সুরা : কাউসার, আয়াত : ১-৩)
চার. কোরবানিতে আত্মসমর্পণ : আল্লাহর নামে পশু কোরবানির মাধ্যমে মুমিন আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণ করে এবং তার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে। কোরবানির আগে দোয়া হিসেবে পঠিত আয়াতে সে ইঙ্গিত রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘বলো! আমার নামাজ, আমার ইবাদত, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু জগত্গুলোর প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তাঁর কোনো অংশীদার নেই এবং আমি এটার জন্যই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১৬২-১৬৩)
আয়াতে জীবন ও মৃত্যু শব্দদ্বয় উল্লেখ করার অর্থ হলো, হে আল্লাহ! আপনার নির্দেশে আমি পশু কোরবানি করছি। আমার জীবনও আপনার জন্য। আপনি নির্দেশ দিলে আমি জীবনও উৎসর্গ করব।
পাঁচ. পশুর গোশত খাওয়ার অনুমতি : আগে উম্মতের জন্য কোরবানির পশুর গোশত খাওয়া বৈধ ছিল না। কিন্তু আল্লাহ মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতের জন্য কোরবানির পশুর গোশত খাওয়া বৈধ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে। তিনি তাদের চতুষ্পদ জন্তু থেকে জীবিকা হিসেবে যা দান করেছেন তার ওপর নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে। অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার করো এবং দুস্থ, অভাবগ্রস্তদের আহার করাও।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ২৮)
লেখক : সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (সিসি), বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা