তবে বাড়িটি ভাঙার পরদিন বৃহস্পতিবার বিকেলে একটি বিবৃতি দিয়েছে সরকার৷ এতে বলা হয়, ‘‘ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনা অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্খিত৷ পলাতক অবস্থায় ভারতে বসে জুলাই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যের কারণে জনমনে গভীর ক্রোধের সৃষ্টি হয়েছে যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে৷”
শুধু ৩২ নম্বরের বাড়ি নয়, ধানমন্ডিতে শেখ হাসিনার বাসভবনও হামলার শিকার হয়েছে, আগুন দেয়া হয়েছে৷ খুলনা, বরিশাল, নোয়াখালী, রাজশাহী ও কুষ্টিয়াসহ আরো কয়েকটি জেলায় আওয়ামী লীগ নেতা ও শেখ পরিবারের সদস্যদের ভবন ও বাড়ি গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷ চট্টগ্রামসহ দেশের কয়েকটি এলাকায় শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার ম্যুরালও ভাঙচুর করা হয়েছে৷ আগুন, হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা অব্যাহত আছে৷ তবে পুলিশ বা যৌথ বাহিনী কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না৷ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটিতে বুধবার রাত ৯টার পর আগুন দেয়া হয়৷ এরপর দুইটি বুলডোজার এনে রাতভর ভাঙা হয়৷ ভাঙার কাজ বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো৷ এই সময়ের মধ্যে শুধু রাতে একবার সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা সেখানে গেলেও কিছুক্ষণ পর তারা সরে যান৷ এছাড়া ঢাকা বা ঢাকার বাইরে আগুন ও ভাঙচুরের ঘটনার সময় যৌথ বাহিনী বা পুলিশ সদস্যদের দেখা যায়নি৷
৩২ নম্বরের ঘটনা প্রসঙ্গে ধানমন্ডি থানার ওসি আলি আহমেদ মাসুদ বলেন, ‘‘আমরাতো যৌথ বাহিনীর সঙ্গে ছিলাম৷ হাজার হাজার লোকের বিক্ষোভের সামনে আমাদের কিছু করার ছিলো না৷ লাখো মানুষের বানের তোড়ে সব কিছু ভেসে গেছে৷ আমরাও ভেসে গেছি৷” ওই ঘটনায় কোনো মামলা বা আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে জানান তিনি৷
ঘটনাক্রম
৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর ভারতে আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ভাষণের ঘোষণা দেন ৫ ফেব্রুয়ারি (বুধবার) রাত ৯টায়৷ এই ঘোষণা দুই-একদিন আগেই দেয়া হয়৷ তারপর প্রবাস থেকে পিনাকী ভট্টাচার্য বুলডোজার দিয়ে ৩২ নম্বর গুড়িয়ে দেয়ার আহবান জানান৷
বুধবার দুপুরে বৈষ্যমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ এক ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘‘আজ রাতে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের তীর্থভূমি মুক্ত হবে৷” রাত ৯টার পরই মিছিল করে গিয়ে ৩২ নম্বরে হামলা ও আগুন দেয়া হয়৷ ৩২ নম্বরে হামলা শুরু হওয়ার পর দেশের অন্যান্য জেলায়ও আওয়ামী লীগ নেতা, দলটির সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও শেখ পরিবারের সদস্যদের বাড়িতে হামলা শুরু হয়৷ তারা পলাতক আছেন৷ ৩২ নম্বরে আগুন ও হামলা শুরুর কয়েক ঘণ্টা পর হাসনাত আব্দুল্লাহ তার ফেসবুকে আরেকটি পোস্টে বলেন, ‘‘ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ৷”
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ তার ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘‘উৎসব হোক!”
তবে উপদেস্টা মাহফুজ আলম তার ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘‘আমরা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক আধিপত্যবাদ মোকাবিলা করছি৷ নিছক কিছু মূর্তি বা দালান নয়৷ মূর্তি না ভেঙে আমাদের উচিত আমাদের শত্রুদের শক্তির বিপরীতে পাল্টা চিন্তা, শক্তি ও হেজেমনি গড়ে তোলা৷ ভাঙার প্রকল্প থেকে সরে এসে দিনকে দিন আমাদের গড়ার প্রকল্প হাতে নেওয়া উচিত৷”
প্রতিক্রিয়া
মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘‘একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে আমি স্তম্ভিত৷ আমার কোনো ভাষা নাই এই বিষয়গুলোর ওপর মন্তব্য করার৷ মানুষ অধিক শোকে পাথর যখন হয় তখন সে স্তম্ভিত হয়৷” তিনি বলেন, ‘‘আমার মনে হয়েছে এখানে রাষ্ট্রের তরফ থেকে উদ্যোগের অভাব আছে৷ ৫ আগস্টের পর একটা পরিস্থিতি ছিলো৷ তখন দেশে সরকার ছিলো না৷ এখন আছে৷ যা কিছু ঘটেছে তা কোনোভাবেই কাম্য ছিলো না৷”
মাসুদ কামাল বলেন, ‘‘শেখ হাসিনার এই সময়ে ভারতে বসে এই সময়ে ভাষণটা দেয়া ঠিক হয়নি৷ তার ভাষণে কী এমন আছে? আমি তো শুনেছি৷ তার এই হঠকারীমূলক কাজ করা ঠিক হয়নি৷”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, ‘‘আমরা প্রচলিত পদ্ধতিতে গণহত্যার বিচার চাচ্ছি৷ সেটা যেন আইনি পথে হয়৷ যে ঘটনা ঘটলো তা অনাকাঙ্খিত এবং অনভিপ্রেত৷ এখানে যেন আর কোনো রক্তপাত না হয়৷ মানুষের ক্ষোভ আছে৷ সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও হচ্ছে৷ ফলে দ্রুত পতিত স্বৈরাচারের সব অপরাধের বিচার হলে মানুষের ক্ষোভ কমবে৷”
রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘‘এত বড় গণঅভ্যুত্থানের বিষয়ে পতিত স্বৈরাচারের কোনো অনুশোচনা নাই৷ তারা দেশের বাইরে বসে নানা ধরনের উসকানি দিচ্ছে৷ এই বিষয়ে সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না৷ হত্যাকাণ্ডের বিচারসহ অন্যান্য বিষয়ে সরকার উদাসীন৷”
‘‘এই প্রেক্ষাপটে বুধবার রাতে বিশেষ করে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জায়গা ৩২ নম্বরসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ঘোষণা দিয়ে হামলা চালানো হলো৷ এটা অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্খিত৷ এটা দেখে যেন মনে হয় দেশে কোনো সরকার নাই৷ এই দায় সরকার কোনোভাবেই এড়াতে পারে না৷ আমরা দাবি করি সরকার এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে,” বলেন তিনি৷
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘‘পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের ভুল পদক্ষেপের কারণেই ওই ঘটনা ঘটেছে৷ তারা এখন পর্যন্ত গণহত্যার দায় স্বীকার করে ক্ষমা পর্যন্ত চায়নি৷ তারা উলটো দম্ভোক্তি করছে৷ তারা যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দেশের মানুষ তা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি৷ তারই প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পাচ্ছি৷ সরকারের উচিত হবে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে গণহত্যার বিচার করা৷”
অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, ‘‘দেশে সরকার আছে৷ আর শেখ হাসিনা ভারতে বসে উসকানি দিচ্ছে৷ খুনিরা উসকানি দিচ্ছে৷ হাসিনাসহ তার দোসরদের ভারত থেকে ফেরত আনতে ভারতের বিরুদ্ধে সরকার কোনো শক্ত ব্যবস্থা নিতে পারেনি৷ শেখ হাসিনা ভারতে বসে সাধারণ মানুষকে বার বার কষ্ট দিচ্ছে৷ সাধারণ ছাত্র-জনতা তাই ঘোষণা দিয়ে যে যতবার কষ্ট দেবে ততবার তার আবেগের জায়গায় আঘাত করবে৷” তিনি বলেন, ‘‘সারাদেশে পতিত স্বৈরাচারের টর্চার সেল আছে৷ এখনো আওয়ামী লীগের লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ সরকারের ব্যর্থতার কারণেই মানুষ আইন হাতে তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছে৷ সরকার যদি দ্রুত তাদের বিচারের আওতায় আনত তাহলে এমন হতো না৷ সরকারের উচিত দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করা৷ আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়িঘর যেগুলো টর্চার সেল হিসাবে ব্যবহার হয়েছে সেগুলো জাদুঘর বানানো যায়৷ আবার আহতদের সেখানে পুনর্বাসনও করা যায়৷ এটা করলে মানুষের ক্ষোভ কমবে৷”
এদিকে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য ফিরোজ আহমেদ তার এক ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, ‘‘আজকে যারা যারা এই কাজটা করেছে, যারা যারা এই কাজের উসকানি দিয়েছে, যেই হোক না কেন সে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া ইউনূস সরকারের কর্তব্য৷” তিনি লিখেছেন, ‘‘বৈধ হিসেবে মনে করেন এমন একটা সরকারের অস্তিত্ব থাকলে কোনো ভবনে বুলডোজার চালানো কিংবা আগুন দেয়া কিংবা ভাঙচুর সন্দেহাতীতভাবেই ফৌজদারি অপরাধ৷”
অন্তর্বর্তী সরকারের বিবৃতি
বৃহস্পতিবার সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনা অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত৷ পলাতক অবস্থায় ভারতে বসে জুলাই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যের কারণে জনমনে গভীর ক্রোধের সৃষ্টি হয়েছ যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে৷
গত ছয় মাসে ৩২ নম্বর বাড়িটিতে কোনো ধরনের আক্রমণ, ধংসযজ্ঞ হয়নি৷ গতকাল (বুধবার) রাতে এটি ঘটেছে পলাতক শেখ হাসিনার বক্তব্য ঘিরে যার দুটো অংশ আছে৷
একটা অংশ হলো, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যারা আত্মদান করেছেন শেখ হাসিনা তাদেরকে অপমান করেছেন, অবমাননা করেছেন৷ শহিদের মৃত্যু সম্পর্কিত অবাস্তব, আজগুবি ও বিদ্বেষমূলক কথা বলে পলাতক শেখ হাসিনা জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে অবজ্ঞা করেছেন ও অশ্রদ্ধা জানিয়েছেন৷
দ্বিতীয়ত, শেখ হাসিনা দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও অমানবিক প্রক্রিয়ায় নিপীড়ন চালিয়ে ক্ষমতায় থাকাকালীন যে সুরে কথা বলতেন গণঅভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়ার পরেও তিনি একই হুমকি-ধামকির সুরে জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে, গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া প্রতিটি মানুষের বিরুদ্ধে কথা বলে চলেছেন, হুমকি ধামকি দিচ্ছেন৷ শেখ হাসিনা দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির হুমকি দিয়েছেন৷
মানুষের মনে জুলাই গণহত্যা নিয়ে যে ক্ষত রয়েছে সে ক্ষততে শেখ হাসিনা একের পর এক আঘাত করে চলছেন৷ তার এই সহিংস আচরণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে৷
এদিকে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এক বিবৃতিতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নানান স্থাপনায় হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে৷ ঘটনাগুলোকে আইনের শাসন ও আইনের যথাযথ প্রয়োগের পরিপন্থি বলে মনে করে আসক৷