শেরপুর প্রতিনিধিঃ
শেরপুরে টানা দু’দিনের অতি বর্ষন ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে শেরপুরের ৩ টি উপজেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। কোন কোন এলাকায় উন্নতি আবার কোন কোন এলাকায় হয়েছে অবনতি।
শুক্রবার বিকালে শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে পাহাড়ি ঢলের পানিতে ডুবে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিখোঁজ হয়েছেন ৩ জন।
নিহতরা হচ্ছে, আন্ধারুপাড়া গ্রামের মৃত মমিরাজের ছেলে ইদ্রিস আলী ( ৮০), বাগবের গ্রামের অমিজা খাতুন (৪৫)। নিখোঁজরা হলেন অভয়না গ্রামের বাজির উদ্দিনের ছেলে আবু হাতেম ও আলম মিয়া, নামাবাদকান্দি গ্রামের মৃত আব্দুল হালিমের স্ত্রী জরদুয়া খাতুন।
এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন শেরপুর জেলা প্রশাসন। তবে নিহত ৩ জনের আজও সন্ধান মেলেনি।
জানা যায়, গত বুধবার থেকে টানা দুই দিনের অতি বর্ষন ও নালিতাবাড়ী উপজেলার ভোগাই চেল্লাখালি, ঝিনাইগাতী উপজেলার মহারশি কালঘোষা, শ্রীবরদী উপজেলার সোমেশ্বরী, কর্ণঝুড়া নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে ৩ টি উপজেলার ২০ ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পরে।
শুক্রবার ভোররাত থেকে নদীগুলোর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ভোগাই চেল্লাখালি, নদীর,ঢলের পানির তোড়ে বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে নদীভাঙ্গন। ভাঙ্গন কবলিত এলাকা দিয়ে ঢলের পানি প্রবেশ করে নালিতাবাড়ী পৌরএলাকাসহ ১১ টি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পরে।
ঝিনাইগাতী উপজেলার মহারশি নদীর পাহাড়ি ঢলের পানির তোড়ে সন্ধাকুড়া থেকে চতল পর্যন্ত অন্তত ২০টি স্থানে ভাঙ্গন দেখা দেয়। দীঘিরপাড় ফাজিল মাদ্রাসাটি হুমকির মুখে।
স্থানীয়রা জানান ওইসব ভাঙ্গান কবলিত দিয়ে প্রবল বেগে ঢলের পানি প্রবেশ করে উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে আর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পরে। সোমেশ্বরী শ্রীবরদী উপজেলার ২টি ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
শুক্রবার রাত থেকে ঝিনাইগাতীর মহারশি, সোমেশ্বরী নদীর পানি কমতে শুরু করলেও ভাটি অঞ্চলে নতুন নতুন এলাকায় ঢলের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
অপরদিকে নালিতাবাড়ির ভোগাই – চেল্লাখালি নদীর পানি অপরিবর্তিত রয়েছে। পানিবন্দি ৩ উপজেলার শতাধিক গ্রামের হাজার হাজার মানুষসহ এখনো ২ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় আছে।
পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে শতশত পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। শতশত একর জমির আমন ফসল ও শাক সব্জি আবাদের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে।
অসংখ্য কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। আজ শনিবার সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ইস্প্রীড বোর্ডের সাহায্যে পানিবন্দি লোকজনকে সরিয়ে নেয়ার পাশাপাশি তাদের মাধ্যে শুকনো খাবার বিতরন করা হচ্ছে।
বিভিন্ন স্থানে পানিবন্দি লোকজনকে প্রশাসনের সহায়তায় উঁচু স্থান ও উচু স্কুল মাদ্রাসায় আশ্রয় নিতে সহায়তা করা হচ্ছে ।
পাহাড়ি ঢলের পানির তোড়ে গ্রামিন রাস্তাঘাট, সেতু বিধ্বস্ত হয়ে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছে। এতে দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে শতশত পথচারীদের।
স্থানীয়রা বিধ্বস্ত রাস্তাঘাট ও বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন।
উপজেলা সদর বাজার, ধানশাইল বাজার, আয়নাপুর বাজারের ব্যবসায়ীদের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। পানিবন্দি এলাকার শতশত বাড়িতে আজও চোলা জ্বলেনি।
পানিবন্দি এলাকাগুলোতে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট। গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি নিয়ে চরম দুর্ভোগে রয়েছেন পানিবন্দি এলাকার মানুষ।
শেরপুরের সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ জসিম উদ্দিন জানান বন্যাকবলিত এলাকায় পানি বাহিত রোগবালাই যাতে ছড়িয়ে পরতে না পারে এ বিষয়ে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য কর্মীরা এলাকায় কাজ করছে।
পানিবন্দি এলাকার লোকজনের মাঝে পানি বিশুদ্ধকরন টেবলেটসহ অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে।
ঢলের পানিতে তলিয়ে কয়েক হাজার পুকুরের কয়েক কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। ফলে বিপাকে রয়েছেন কয়েক হাজার মৎস্য চাষি।
আকর্ষিক পাহাড়ি ঢোলের পানির তোড়ে শতাধিক কাচা ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। গৃহহীন অনেকে আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
আবার অনেকেই সন্তানাদি নিয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করে আসছেন।
হাজার হাজার একর জমির আমন ফসল ও শাকসবজি ক্ষেত পানির নিচে নিমজ্জিত হয়েছে। উঠতি আমন ফসলের ক্ষতি সাধিত হওয়ায় হাজারো কৃষক দিশেহারা হয়ে পরেছে।
শ্রমজীবি মানুষ কাজে যেতে পারছেন না। অনাহারে অর্ধাহারে মানবেতর জীবনযাপন করে আসছেন।
পাহাড়ি ঢলের পানির তোড়ে বিদ্যুতের খুটি উপড়ে পরে বৃহস্পতিবার রাত থেকে এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে। জানা গেছে, বিদ্যুৎ বিভাগ জোরাতালি দিয়ে অনিয়মিতভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আসছেন ।
এতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনো পানির নিচে।
এদিকে ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশরাফুল আলম রাসেল সকাল থেকে ভাঙ্গন কবলিত এলাকাগুলো পরিদর্শন করেন। এবং দ্রুত সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
শেরপুর জেলা খামারবাড়ির অতিরিক্ত উপ-পরিচালক কৃষিবিদ হুমায়ুন কবির বলেন পাহাড়ি ঢলের পানিতে ১২ হাজার হেক্টর আমন আবাদ নিমজ্জিত হয়েছে।
৩শ হেক্টর জমির শাক সব্জি ক্ষেতের ক্ষতি সাধিত হয়েছে। তিনি বলেন ক্ষতির পরিমান আরো বেশি হতে পারে। এ বিষয়ে কর্মকর্তা কর্মচারীরা মাঠে কাজ করছে পরবর্তীতে তা জানা যাবে
শেরপুরের জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলায় পাহাড়ি ঢলের পানি কমতে শুরু করায় পরিস্থিতি অনেকটাই উন্নতি হয়েছে।
তবে নালিতাবাড়ীতে এখনও অপরিবর্তিত রয়েছে। পানিবন্দি এলাকার লোকজনকে সরিয়ে নিতে সেনাবাহিনী কাজ করছে।
বিধ্বস্ত ঘর-বাড়ি রাস্তাঘাটের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে তালিকা তৈরির নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
ক্ষতির পরিমান পরে জানা যাবে। তবে ঢলের পানি কমতে শুরু করায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বারছে বাড়ছে বলে দাবি তার।
তিনি বলেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার আগমুহূর্ত পর্যন্ত প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের সমন্বয়ে পানিবন্দি এলাকার লোকজনকে উদ্ধার তৎপরতা চলছে। তবে দ্রুতই এ সমস্যার সমাধান হবে বলে আসাবাদি তিনি।
Tags: পাহাড়ি