এতদিন জনবল সংকট সামাল দিতে তাই টেম্পোরারি লেবার রিক্রুটমেন্ট (টিএলআর) পদ্ধতিতে অস্থায়ী কর্মচারী দিয়ে দৈনন্দিন সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। বর্তমানে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে রাষ্ট্রায়ত্ত বৃহৎ পরিবহন সেবা সংস্থাটির বিভিন্ন দপ্তরে কাজ করছেন প্রায় সাত হাজার টিএলআর শ্রমিক। তবে এ পদ্ধতি থেকে সরে এসে রেলওয়ে এবার আউটসোর্সিং এ লোকবল নিয়োগ দিতে চাইছে, তাতেই তৈরি হয়েছে অস্থিরতা। লোকবল ছাঁটাই করে আউটসোর্সিং পদ্ধতি চালু হলে রেলওয়ের সেবা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। টিএলআর কর্মীদের বাদ দিয়ে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে লোকবল নিয়োগে রেলওয়ে ২০১৮ সালে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে। যদিও এখন পর্যন্ত সেটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি তারা। সর্বশেষ ১ জুলাই থেকে সব টিএলআর কর্মী বাদ দিয়ে আউটসোর্সিং চালুর প্রক্রিয়া শুরু করায় নিয়োগ বিধি লঙ্ঘন ছাড়াও রেলের জরুরি সেবা কার্যক্রম ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ইতিমধ্যে ২৭শে ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে নিয়োগ বিধিমালা ২০২০ সংশোধনে কমিটি গঠন করে সে সময়ে মধ্যে নিয়োগ কার্যক্রম চালিয়ে রেলওয়ে একটি আইনি জটিলতার সৃষ্টি করেছে। একদিকে নিয়োগ বিধিমালা সংশোধনে ইচ্ছাকৃত ভাবে বিলম্ব করছে অন্যদিকে নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা ও দক্ষ টিএলআর শ্রমিকদের বাদ দিয়ে নতুন ভাবে আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে জনবল নিয়োগের উদ্যোগ রেল অঙ্গনে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। নিয়োগ বিধিমালা সংশোধন না করেই জনবল নিয়োগ সম্পূর্ণ বেআইনী। ফলে ইতিমধ্যে খালাসী, ওয়েম্যান, বুকিং সহকারী, লোকোমোটিভ মাস্টার, গার্ড, স্টেশন মাস্টার, পয়েন্টসম্যান পদে যে জনবল নিয়োগ হয়েছে আপাত দৃষ্টিতে সেটিও অবৈধ। তাই বর্তমানে আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে জনবল নিয়োগের যে চেষ্টা চলছে সেটা যে বেআইনী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
রেলওয়ে নিয়োগ বিধি অনুযায়ী, পি—ম্যান (পয়েন্টসম্যান), গেটম্যান বা গেইট কিপার, পোর্টার, খালাসি, ওয়েম্যান, ক্যারেজ খালাসি পদগুলো অত্যাবশ্যকীয়। এগুলোয় সরাসরি কিংবা পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়োগের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু রেলওয়েতে কর্মরত অত্যাবশ্যকীয় সহ সব টিএলআর কর্মীকেই বাদ দিয়ে তিন মাসের মধ্যে এসব পদে আউটসোর্সিং এর লোকবল নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলওয়ে। এক্ষেত্রে দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি নিচ্ছে রেলওয়ের সংস্থাপন শাখা। রেলওয়ের এমন সিদ্ধান্তে টিএলআর কর্মীরা আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবেন। ফলে রেলওয়েতে নতুন করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, রেলওয়েতে ৫০০ জনের মতো পি—ম্যান টিএলআর কর্মরত ছিলেন। এরই মধ্যে তাদের চাকরি থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে কর্মরত সাড়ে তিন হাজারের অধিক গেটম্যান, এক হাজারের অধিক পোর্টার, প্রায় ৪০০ খালাসি, পাঁচ শতাধিক ওয়েম্যান, প্রায় দুই হাজার ক্যারেজ খালাসিকেও সরিয়ে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগের কাজ শুরু করেছে রেলওয়ে। দীর্ঘ সময় কাজ করার পর অনিশ্চিত কর্মজীবনের ভয়ে সেই কর্মীরা এখন কাজ বন্ধ করে দিলে রেলওয়ের পরিচালনায় বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন রেলওয়ের অনেক কর্মকর্তা।
রেলওয়েতে কেন একটি পক্ষ এমন সংকট সৃষ্টির পায়তারা করছে তা বের করতে মহাকাশ বিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই। বর্তমান রেলমন্ত্রীর অধীনে রেলওয়েতে নতুন নিয়োগ মানেই কিছু অসাধু কর্মকর্তা—কর্মচারীর পকেট ভারী হওয়া। তাই তারা আইনের তোয়াক্কা না করে নবনিয়োগে ব্যস্ত। অপরদিকে আউটসোর্সিং নিয়োগ মানেই ঠিকাদারদের কাছে মোটা অংকের উৎকোচ গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি। অপরদিকে ঠিকাদারেরা রয়েছেন চাকরি প্রার্থীদের কাছে থেকে চাকরির বিনিময়ে অর্থ গ্রহনের সুযোগের অপেক্ষায়। দুর্নীতির উদ্দেশ্যেই এই কুচক্রী মহলটি কোন আইনের তোয়াক্কা না করে নিয়োগবিধি সংশোধনকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে বিলম্বিত করে আউটসোর্সিং ও নবনিয়োগ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এখনই এই দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে না পারলে বাংলাদেশ রেলওয়েতে দেখা দেবে চরম বিশৃঙ্খলা, ব্যাহত হবে যাত্রী সেবা, পথে বসবে অসহায় হাজার হাজার দক্ষ টিএলআর শ্রমিক।
আমরা আশা করছি বাংলাদেশ রেলওয়ের সংকট কাটাতে রেলওয়ের সৎ—নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা—কর্মচারীরা এগিয়ে আসবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে বাংলাদেশ রেলওয়ের আকাশে জমে থাকা কালো মেঘ সরে নতুন সূর্য উদিত হবে এই প্রত্যাশায় রয়েছেন দেশের হাজার হাজার রেল কর্মকর্তা, কর্মচারী, টিএলআর শ্রমিক ও রেলওয়ে পোষ্যরা।