অনলাইন ডেস্ক♦
দেশে ২০০৪ সালের ২১শেআগস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার এক সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলো ২৪ জন-যে ঘটনা একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা হিসেবে পরিচিত।
পরে এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার রায়ে আদালত বলেছিলো – ‘রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের সহায়তায় ঐ হামলার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা করা হয়েছে।’ রায়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং ক্ষমতাসীন দল বিএনপির একজন নেতা আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
সতের বছর আগের ওই ভয়াবহ সহিংসতার পর দেশে বিদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিলো। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অর্থাৎ তখনকার বিশ্ব নেতারা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ঘটনার জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনতে তখনকার বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের প্রতি বারংবার আহবান জানিয়েছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, “আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সমাবেশের সেই ভয়ংকর ঘটনা পুরো বিশ্বকেই নাড়া দিয়েছিলো যা তাদের পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট হয়েছিলো। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন বা ইউরোপ – সবাই দফায় দফায় এ নিয়ে তখন বিবৃতি দিয়েছে, কথা বলেছে।”
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ এর হামলার পর তখন এমনিতেই বিশ্ব সন্ত্রাসবাদ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলো এবং যুক্তরাষ্ট্র ও সমমনা দেশগুলো এ বিষয়ে বৈশ্বিকভাবে কাজ করছিলো। এমন এক পরিস্থিতিতে ঢাকার সেই ভয়াবহ হামলা সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকিকেই আরও স্পষ্ট করে দিয়েছিলো-যে কারণে গ্রেনেড হামলা নিয়ে বেশ উদ্বেগ তৈরি হয়েছিলো পশ্চিমা বিশ্বে এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে।
“সহিংসতার ভয়াবহতা ছাড়াও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বৈশ্বিক কারণেই ঘটনাটিকে গুরুত্ব দিতে হয়েছে। কারণ রাজনৈতিক সহিংসতার আবরণে নানা জায়গায় সন্ত্রাসবাদ বাড়ছিলো, ” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
একুশে আগস্ট বিকেলে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে শেখ হাসিনার সমাবেশে হামলার খবর মুহূর্তেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো ঘটনার পর থেকেই খবরটি প্রচার শুরু করলে প্রতিক্রিয়া আসতে শুরু করে সারা বিশ্ব থেকেই।
ঢাকায় তখন থমথমে পরিস্থিতি। হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেদিন রাতে হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনাকে ফোন করেন তখনকার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। এর পরপরই বিবৃতি দেন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়শকা ফিশার।
মিস্টার সিং বেশ কিছুক্ষণ শেখ হাসিনার সাথে আলোচনা করেন যেখানে সার্বিক পরিস্থিতিই উঠে এসেছিলো বলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো।
মূলত সেই রাত থেকেই পরবর্তী কয়েকদিন বিভিন্ন দেশ, সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠন থেকে ধারাবাহিকভাবে বিবৃতি আসতে থাকে। শেখ হাসিনার সাথে ফোনে কথা বলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েলসহ বিশ্ব নেতাদের অনেকে।
ঘটনার পরদিন অর্থাৎ ২২শে আগস্ট শেখ হাসিনার সাথে ফোনে কথা বলেন তখনকার তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী নেক মেতিন এরবাকেন, ভারতের কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী, ভারতীয় লোকসভায় বিরোধী দলীয় নেতা এল কে আদভানি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিনা রোকা।
এছাড়া পৃথক ভাবে বিবৃতিও আসে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারতীয় হাইকমিশনের পক্ষ থেকে যাতে স্পষ্টভাবেই হামলার সাথে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি সুস্পষ্ট আহবান জানানো হয়েছিলো।
বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস বলে: “এধরণের ঘৃণ্য রাজনৈতিক সন্ত্রাসের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। বিরোধী দলের নেতৃত্ব নিশ্চিহ্ন করার এমন কমান্ডো স্টাইল হামলা সফল হলে এটি গণতন্ত্র ও বাংলাদেশের ভবিষ্যতকে ক্ষতিগ্রস্ত করতো।”
মূলত হামলাকে পশ্চিমা দেশগুলো বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার একটি চেষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করায় সেটি তখনকার সরকারের ওপরও চাপ তৈরি করে।
পাশাপাশি ঢাকায় ইউরোপীয় কূটনীতিকরা একটি যৌথ বিবৃতি দিয়ে তৎকালীন সরকারকে ঘটনার তদন্ত করে দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার আহবান জানান। একই সাথে তারা শেখ হাসিনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করারও আহবান জানান।
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাস ও ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বিনা সিক্রী সেদিন ঢাকায় আলাদাভাবে শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাত করে তাকে সমবেদনা জানান ও পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।
২৩শে আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ গভীর দু:খ প্রকাশ করেন। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে ফোন করে প্রেসিডেন্ট বুশের বার্তা পৌঁছান এবং এসময় তিনি শেখ হাসিনার ওপর হামলারকারীদের জনগণের শত্রু হিসেবে বর্ণনা করেন।
পরে ওয়াশিংটনে দেয়া এক বিবৃতিতে মিস্টার পাওয়েল জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার আহবান জানান।
ওইদিন যুক্তরাজ্যসহ আরও কয়েকটি দেশ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাক স্ট্র এক বিবৃতিতে বলেন, “বাংলাদেশে কর্তৃপক্ষ জড়িতদের বিচারের আওতায় আনবে বলে আমরা আশা করছি।”
ঢাকায় ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাত করেন। এছাড়া নেদারল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইটালির রাষ্ট্রদূতরাও তার সাথে সাক্ষাত করে নিজ দেশের সরকার প্রধানের বার্তা পৌঁছে দেন।
ওই দিনই শ্রীলংকার রাষ্ট্রদূত ছাড়াও পাকিস্তানের সিনেটর ইকবাল হায়দার শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাত করেন।
এরপর ২৪শে আগস্ট তখনকার জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান এবং পরদিন ২৫শে আগস্ট ঢাকায় বিদেশি দূতাবাসগুলো আবার বিবৃতি দিয়ে ঘটনার তদন্তে সরকারের ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন, যা তখন ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়।
এক পর্যায়ে ঢাকায় তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ২১শে অগাস্টের ঘটনা নিয়ে ব্রিফিং-এর জন্য বিদেশি দূতদের আমন্ত্রণ জানালেও তারা তাতে অংশ নেননি এমন খবরও উঠে আসে গণমাধ্যমে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এমন চাপের মধ্যেই ২৫শে অগাস্ট কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেল ডন ম্যাককিনন শেখ হাসিনাকে ফোন করেন এবং তার স্বাস্থ্যের খোঁজ নেন। একই দিন জাপান ও অস্ট্রেলিয়াও পৃথক বিবৃতি দেয়।
অষ্ট্রেলিয়া সরকারের বিবৃতিতে স্পষ্ট করেই বলা হয়, “এই ঘৃণ্য হামলার ঘটনার কোন যুক্তি থাকতে পারে না।”
সব পক্ষকে ধৈর্য ধারণ করা এবং জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানানো হয় তাতে।
এর মধ্যে ঘটনা তদন্ত নিয়ে সরকারের কিছু পদক্ষেপ সমালোচনা তৈরি করলে ২৬শে অগাস্ট ঢাকায় কূটনৈতিক কোরের ডীন শাহতা জারাবের নেতৃত্বে ১৯ জন কূটনীতিক শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাত করেন এবং পরে তারা ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের ওপর গুরুত্ব দেন।
আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন ২১শে আগস্টের ওই ঘটনার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া ও দৃশ্যমান তৎপরতার কারণে তখনকার সরকারের ওপর একটি চাপ তৈরি হয়েছিলো।
বিশেষ করে ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতরা হামলার ঘটনায় সুষ্ঠু এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত তদন্তের আহবান জানাচ্ছিলেন বারবার। তাদের এ ধরনের আহবান থেকে বোঝা যায়, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ তদন্ত নিয়ে তখন তাদের মনে আশংকা তৈরি হয়েছিলো।
যদিও তখনকার ক্ষমতাসীন বিএনপি বারবার এফবিআই ও ইন্টারপোলের মতো সংস্থাকে তদন্তে সম্পৃক্ত করার কথা বলছিলো, কিন্তু সরকারের নানা পদক্ষেপ নিয়ে তীব্র সমালোচনা আসছিলো আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর দিক থেকে।