আমিরুল ইসলাম কবিরঃ
মিশ্র ভাষায় ও আঞ্চলিক ভাষার মানুষের কন্ঠে প্রতিবাদী শব্দে কন্ঠ ও যন্ত্র মাদল ছিলো গাইবান্ধা পৌর শহরের প্রানকেন্দ্রখ্যাত এলাকা। প্রতিবাদী গানে নৃত্য ও মিছিল-সমাবেশের মধ্য দিয়ে গাইবান্ধায় আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালন করা হয়েছে। ‘আদিবাসী’ সাঁওতাল সম্প্রদায় সহ বাঙ্গালী চেতনায় উজ্জীবিত বিভিন্ন ধর্মমতের সুধীজনের মিশ্র কন্ঠে প্রতিবাদী শব্দ ভেসে উঠে ৯ আগস্ট মঙ্গলবার দুপুরে গাইবান্ধা গানাসাস মার্কেটের সামনে।
আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদ,সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি, সামাজিক সংগ্রাম পরিষদ ও নাগরিক সংগঠন জনউদ্যোগ গাইবান্ধার এ কর্মসূচীর যৌথভাবে আয়োজন করে।
এ কর্মসূচীতে ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীর অধিকার ও দাবী সম্বলিত ব্যানার,ফেস্টুনসহ তিন শতাধিক সাঁওতাল নারী-পুরুষ তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, বাদ্যযন্ত্র ও তীর-ধনুক নিয়ে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রাটি শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে সমাবেশস্থলে এসে শেষ হয়। পরে ‘আদিবাসী’ সাঁওতাল নারী-পুরুষরা প্রতিবাদী গান ও নৃত্য পরিবেশন করেন।
‘ঐতিহ্যগত বিদ্যা সংরক্ষণ ও বিকাশে আদিবাসী নারীদের অবদান চির স্বীকৃত’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে নিয়ে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তারা বলেন,‘সারাদেশে সাঁওতালসহ ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠী মানবাধিকার এবং জীবনমানের সার্বিক দিক দিয়ে আজও নানাভাবে বঞ্চিত এবং সে কারণেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী থেকে তারা পিছিয়ে পড়া অবহেলিত জনগোষ্ঠী। তারা বলেন,সমতলের ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠী আজ বিলুপ্ত হওয়ার পথে। শুধু একটি জনগোষ্ঠীই বিলুপ্ত হচ্ছে না, সেইসাথে তাঁদের সংস্কৃতি এবং ভাষাও বিলুপ্ত হচ্ছে। এরা বাংলাদেশের দরিদ্রতম জনগোষ্ঠী। অধিকাংশই ভূমিহীন,তাঁদের হাতে ভূমি নেই’।
মানবাধিকার কর্মী শহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম-ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ডা. ফিলিমন বাসকে। বক্তব্য রাখেন, আদিবাসী -বাঙালী সংহতি পরিষদের আহ্বায়ক অ্যাড. সিরাজুল ইসলাম বাবু,জন উদ্যোগ গাইবান্ধার সদস্য সচিব প্রবীর চক্রবর্তী,আদিবাসী নেত্রী প্রিসিলা মুরমু,তৃষ্ণা মুরমু, গাইবান্ধা সামাজিক সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক জাহাঙ্গীর কবির তনু,বাংলাদেশের ওয়ার্কাস পার্টি (মার্কসবাদী) নেতা মৃণাল কান্তি বর্মন, আদিবাসী নেতা সুফল হেমব্রম, থমাস হেমব্রম,নিরঞ্জন পাহান, মানবাধিকার কর্মী গোলাম রব্বানী মুসা,অঞ্জলী রানী দেবী, কাজী আব্দুল খালেক, বাংলাদেশ রবিদাস ফোরাম এর সাধারণ সম্পাদক খিলন রবিদাস প্রমুখ।
এসময় সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম-ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির নেতা ময়নুল ইসলাম, অ্যাড. কুশলাশীষ চক্রবর্তী, অ্যাড. ফারুক কবীর,অ্যাড. মোহম্মদ আলী প্রামানিকসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন।
সাঁওতাল নেতারা বলেন, আদিবাসীরা জাতীয়তাবাদী ঘৃণার শিকার। ১৯৭১ সালের আগে আমরা যেমন পাকিস্তানিদের ঘৃণার শিকার হয়েছি,তেমনি আজ আমরা বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ও সরকারের ঘৃণার শিকার হচ্ছি। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে ক্রমাগত সাঁওতালসহ আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগকারী সাঁওতালরা তাদের অধিকার ও মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। সাঁওতাল হত্যা,লুটপাট, অগ্নিসংযোগের পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। এমন একটি বিভৎস,অমানবিক ঘটনার আজও বিচার কাজ শুরু হয়নি। সাঁওতাল হত্যা মামলার আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের কেউ গ্রেফতার করে না। এ নিয়ে সাঁওতালদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা সরকারের প্রতি তিন সাঁওতাল হত্যায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করে বিচার এবং জমি ফেরতের পাশাপাশি বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ,ভাঙচুর,লুটপাটের ঘটনায় ক্ষতিপূরণের দাবি জানান।
বক্তারা এসময় আরো বলেন, সাঁওতালদের রক্তে ভেজা জমিতে ইপিজেড করতে দেয়া হবে না। আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে; সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠন করার দাবী জানান তারা।
উল্লেখ্য,গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ এলাকায় রংপুর চিনিকলের আওতায় ১ হাজার ৮’শ ৪২ একর জমি আছে। এসব জমি ফিরে পেতে দখলী বসবাস শুরু করে বিগত ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর চিনিকল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ এসব জমিতে উচ্ছেদ করতে গেলে সাঁওতালদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এতে তিন সাঁওতাল শ্যামল হেমব্রম,রমেশ টুডু ও মঙ্গল মার্ডি নিহত হন। আহত হন অন্তত ২৫ জন। এই পরিস্থিতিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ রপ্তানী প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (বেপজা) কর্তৃপক্ষকে ইপিজেড বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। বেপজা সাহেবগঞ্জ এলাকায় ইপিজেড স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু স্থানীয় সাঁওতালরা এখানে ইপিজেড স্থাপনে বিরোধিতা এবং ওই জমিকে পৈতৃক দাবি করে জমি ফেরত পেতে আন্দোলনে নামেন। সাঁওতালরা গঠন করেন সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি। ইক্ষু খামারের জমিতে মানববেতর জীবন যাপন ও বাপ দাদার জমি উদ্ধারে সংগ্রাম চলমান রেখেছেন তারা।