সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি (রহ.):
পারস্য সাম্রাজ্যের সেনাপতি রুস্তম মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)-এর কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, তিনি যেন কোনো মুসলিমকে তাঁদের কাছে পাঠান, যার সঙ্গে তাঁদের এই অভিযানের উদ্দেশ্য জানা যাবে। বার্তা পেয়ে সাদ (রা.) রিবয়ি ইবনে আমের (রা.)-কে পাঠালেন। রুস্তমের রাজসিক দরবার, জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক ও অমূল্য রাজমুকুট, গমগমে ভীতিপ্রদ পরিবেশ— কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করলেন না রিবয়ি ইবনে আমের (রা.)। তিনি রুস্তমের একেবারে পাশে গিয়ে বসলেন। রুস্তম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা কেন এসেছ?’ তিনি বলেন, ‘আল্লাহ আমাদের আবির্ভূত করেছেন, যেন মানবজাতিকে মানুষের দাসত্ব থেকে আল্লাহর দাসত্বের দিকে নিয়ে আসি। তাদের ব্যাপারে আল্লাহ যেমনটি ইচ্ছা করেছেন, যেন আমরা মানুষকে দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে তাঁর প্রশস্ততার দিকে, বিভিন্ন ধর্ম-মতবাদের অবিচার থেকে ইসলামের ন্যায়-ইনসাফের দিকে আহ্বান করি। তিনি আমাদের তাঁর দ্বিন দিয়ে তাঁর বান্দার কাছে পাঠিয়েছেন, যেন আমরা তাদের সেদিকে ডাকি।’ এই সহজ ও সারগর্ভ বক্তব্যের শুধু একটি বাক্য ‘দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে তাঁর প্রশস্ততার দিকে’র প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করব।
রিবয়ি ইবনে আমের (রা.) জানতেন, পারস্যের শাসকরা প্রজাদের তাদের উপাসকে পরিণত করেছে। তাদের আচরণ কেবল প্রভু-ভৃত্যের ছিল না, ছিল উপাস্য ও উপাসকের মতো। আল্লাহর রাসুলের সাহাবিরা বিশ্বাস করতেন, একমাত্র ইসলামই ন্যায় ও সুবিচারের ধারক, আর অন্য সব ধর্ম ও মতবাদ অন্যায়-অবিচারে পূর্ণ, যা মানুষকে মানুষের দাসে পরিণত করে, সাধু-পুরোহিতের উপাসক বানিয়ে ছাড়ে। তাঁরা কোরআনের এই আয়াত পাঠ করেছিলেন—‘যারা অনুসরণ করে রাসুলের, উম্মি নবীর, যাঁর উল্লেখ তারা তাওরাত ও ইঞ্জিলে পায়—যা তাদের কাছে আছে। যে তাদের সত্ কাজের নির্দেশ দেয় ও অসত্ কাজে বাধা দেয়, যে তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করে ও অপবিত্র বস্তু হারাম করে এবং যে মুক্ত করে তাদেরকে তাদের গুরুভার ও শৃঙ্খল থেকে, যা তাদের ওপর ছিল। সুতরাং যারা তাঁর প্রতি ঈমান আনে, তাঁকে সম্মান করে এবং যে নূর তাঁর সঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে তার অনুসরণ করে, তারাই সফলকাম। (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৫৭)
তিনি বলেছেন ‘দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে তাঁর প্রশস্ততার দিকে’। এখানে আমি আশ্চর্য হয়ে নিজেকে প্রশ্ন করছি, কী সেই প্রশস্ততা, যা আরবরা উপভোগ করছিল? আর কী সেই সংকীর্ণতা, যাতে পারস্যবাসী বন্দি ছিল? সেকালের আরব-জীবন প্রশস্ত আর পারসিকদের জীবন কি সংকীর্ণ ছিল? এই প্রশ্ন আমরা ইতিহাসকে করতে পারি। ঐতিহাসিকরা একমত, রোম-পারস্যের জীবন ছিল প্রাচুর্যের মখমল জীবন, বিলাসিতার কমনীয় জীবন। পক্ষান্তরে আরবের জীবনযাত্রা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসলামের আবির্ভাবের পরও তারা ছিল রুক্ষ জীবনে অভ্যস্ত। আরব উপদ্বীপের এই মরুময় জীবন রোম-পারস্যের চোখে ছিল দারিদ্র্য ও পশ্চাত্পদতা, ওদের দৃষ্টিতে করুণা ঝরত—আহা, কী বঞ্চনা! কী সংকীর্ণতার জীবন! কাজেই প্রশ্ন জাগে, কী সেই সংকীর্ণতা, যাতে পারসিকরা বন্দি ছিল? এটা কি কপটতার অতিরঞ্জন? সেনাপতি রুস্তমকে রিবয়ি ইবনে আমের (রা.)-এর মনে হয়েছে সোনার খাঁচায় বন্দি এক আদুরে বিহঙ্গ। আরেকটু এগিয়ে বলতে পারি, কারো কি হিংসা হতে পারে এমন একটি কুকুরের ওপর, যে প্রতিপালিত তার ইউরোপীয় মনিবের অফুরন্ত আদর-সোহাগে? তার জন্য রয়েছে সুস্বাদু খাবার, সুমিষ্ট ফল, সুপেয় দুধ! আছে সোনা-রুপার গলাবন্ধ! আছে নরম তুলতুলে শয্যা? আদর-সোহাগে পালিত একটি কুকুরকে আমরা যেভাবে দেখি, রিবয়ি (রা.) রুস্তমকে সে নজরেই দেখছিলেন। কেননা যে বিশ্বাসে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন, যে পয়গামের তিনি বাহক ছিলেন, যে ব্যক্তিত্বের তিনি অধিকারী ছিলেন এবং যে কোরআনের তিনি অনুসারী ছিলেন, সেই মহাসম্পদের মূল্য সম্পর্কে তিনি ছিলেন পূর্ণ সচেতন। ফলে সভ্যতার আলোকচ্ছটা না তাঁর দৃষ্টিকে নিষ্প্রভ করতে পেরেছে, না তাঁর মন-মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করতে পেরেছে। বর্তমান ইউরোপীয় কৃষ্টি-কালচারও কি এজাতীয় নানা আরোপিত রীতি-নীতির সমষ্টি নয়? অর্থহীন শর্ত, মনগড়া পরিভাষা, অপ্রয়োজনীয় রীতি-নীতি ইউরোপীয়রা নিজেদের ওপর আরোপ করেছে। তাদের অনুসারীরাও সেই ভার বহন করে চলেছে। আরবদের মধ্যে হীনম্মন্যতার লেশমাত্রও ছিল না। ভীরুতা ও নতজানুতার অপচ্ছায়া থেকে তারা ছিল মুক্ত। আজ যদি তারা পশ্চিমা সভ্যতা দেখত, দেখত আরবদের বিলাসী জীবন, তাহলে তাদের সম্পর্কেও তাদের মূল্যায়ন তা-ই হতো, যা হয়েছে রোম ও পারস্যের ব্যাপারে। এদেরও তারা দুনিয়ার সংকীর্ণ জীবন থেকে মুক্ত করার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করত।
আজ আমি একটি পয়গাম আমানত রেখে যেতে চাই, সাধ্যের শেষ সীমা পর্যন্ত এই আওয়াজ পৌঁছে দিতে চাই। আজ আরব জাতির, পূর্ব-পশ্চিমের মুসলিম জাতির অনিবার্য প্রয়োজন, সেই মর্দে মুমিনের আলোকিত দৃষ্টি, যাতে আছে ঈমানের দ্যুতি, আত্মপরিচয়ের গৌরব। এই দীপ্ত দৃষ্টিতেই আজ তাকাতে হবে বর্তমানের গলিত সভ্যতার দিকে, যা চারপাশ থেকে আমাদের বেষ্টন করে রেখেছে। আমরা তো অনাহূত অপজাত নই; পৃথিবীর বুকে ভাসমান কোনো জাতি নই, যাদের না আছে বংশপরিচয়, না কৌলিন্য-আভিজাত্য, না কীর্তি-অবদান, না ইতিহাস-ঐতিহ্য। আমরা সমৃদ্ধ ধনী। আমরাই ছিলাম এই পৃথিবীর শিক্ষক। কিন্তু কেন আজ এই তিক্ত বাস্তবতা? নীতি ও কর্মে স্বাধীন এক জাতি কিভাবে পরাধীন হয়ে গেল? আল্লাহ আরব ঐতিহাসিকদের উত্তম প্রতিদান দিন, যাঁরা এই অনির্বাণ বাক্যশিখাটি সংরক্ষণ করেছেন, যাতে আছে ঈমানের জ্যোতি, প্রথম যুগের আরবীয় ব্যক্তিত্বের দ্যুতি, আল্লাহ যাঁদের ইসলামী শিক্ষার চিরন্তন আলোয় আলোকিত করেছিলেন এবং যাঁরা এর মর্যাদা সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন ছিলেন। এতেই তাঁরা সন্তষ্ট ও পরিতৃপ্ত ছিলেন। একেই তাঁরা সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করতেন। বর্তমান চিন্তা, দর্শন ও তার চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবেলায় রুখে দাঁড়াতে হবে এক সাহসী সুঠামদেহী বীরপুরুষের মতো, যে সচেতন নিজের শক্তি ও মর্যাদা সম্পর্কে, গৌরবান্বিত নিজের বার্তা ও ব্যক্তিত্বে; যে তার প্রতিভার ব্যবহারে কুশলী, গ্রহণ-বর্জনে স্বাধীন, বর্তমান সভ্যতা থেকে সে ততটুকু গ্রহণ করে, যা তার জন্য উপকারী, তার আদর্শ-উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ,যা তাকে নবশক্তিতে বলীয়ান করে।
দীর্ঘ ভাষণের নির্বাচিত অংশ ভাষান্তর করেছেন মুফতি আবদুল্লাহ নুর|