||গাজী হাসান মাহমুদ, লেখক-কলামিস্ট||
“মুজিব হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না, যারা মুজিবকে হত্যা করেছে তারা যেকোনো জঘণ্য কাজ করতে পারে”-নোবেল বিজয়ী উইলিবান্ট
পৃথিবীর ইতিহাসে অসংখ্য রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। ইসলামের ৫ জন খলিফার মধ্যে হযরত আবু বকর (রাঃ) ছাড়া বাকী ৪ জনই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। বিশেষ কয়েকটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন, জন এফ কেনেডি, নোবেল জয়ী মানবাধিকার কর্মী মার্টিন লুথার কিং, ভারতের জাতির পিতা শ্রী মহাত্মা গান্ধী, প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, প্রধানমন্ত্রী শ্রী রাজীব গান্ধী, মিয়ানমারের অং সান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক, পাকিস্তানের প্রথম ও একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টো হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করার মত। ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সালের কালরাত্রিতে মহান স্বাধীনতা ও বাংলাদেশের স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যসহ ২২ জনের নারকীয় হত্যাকাণ্ডটি ছিল অন্য যেকোন হত্যাকাণ্ডের চেয়ে আলাদা। সৌভাগ্যক্রমে বেলজিয়ামে থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ইতিহাসের ঘৃণ্য এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে একটি পরিবারের সবাইকে একযোগে হত্যা করা হয়েছে, একই সাথে আলাদা ৩টি বাড়িতে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। ৪ বছর বয়সী শিশু সুকান্ত আব্দুল্লাহ বাবু, ১০ বছরের শেখ রাসেল থেকে শুরু করে গৃহপরিচারিকা কেউই বাদ যায়নি। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা দ্বিতীয়টি নেই। উল্লেখ্য, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের রাতে ঘাতকদের ছোড়া কামানের গোলার আঘাতে মোহাম্মদপুরের বস্তির ১৪ জন নিহত হয় এবং প্রায় ৪০ জন আহত হয় যা ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের একটি অংশ।
বঙ্গবন্ধু হত্যার কলঙ্ক বাঙালিদের আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে, ইতিহাস সব সময় বাঙালিদের অবিশ্বাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার দায় থেকে বাঙালিদের মুক্তি নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর শেখ হাসিনা যখন বেলজিয়াম ও জার্মানি হয়ে ভারতে আসছিলেন তখন বিমানবন্দরের একজন ইমিগ্রেশন পুলিশ অফিসার তাঁর পাসপোর্টে বাংলাদেশ লেখা দেখে বলেছিলেন-“তোমরা তোমাদের জাতির পিতাকে হত্যা করেছ!”
বিশ্ব ও মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সেদিন তারা কেবল বঙ্গবন্ধুকেই নয়, তার সঙ্গে বাঙালির হাজার বছরের প্রত্যাশার অর্জন স্বাধীনতার আদর্শগুলোকেও হত্যা করতে চেয়েছিল। মুছে ফেলতে অপপ্রয়াস চালিয়েছিল বাঙালির বীরত্বগাথার ইতিহাসও। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শ নির্মূল করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এই হত্যাকাণ্ডটি শুধু একজন ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির হত্যাকাণ্ড ছিল না, এটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা মূলনীতির হত্যাকাণ্ড। ১৫ আগস্ট নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশকে ইসলামিক রিপাবলিক ঘোষণা করা হয়, যদিও খুনিদের সেই অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়। হত্যাকাণ্ডের পরদিনই সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, ৩১ আগস্ট বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় চীন। এসবই ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ খুনের একেকটি আলামত।
এই নৃশংস হত্যাকণ্ডের সামনের সারিতে আমরা কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যদের দেখলেও এর পেছনের মূলশক্তিকে আমরা কখনই দেখতে পাইনি শুধুমাত্র খুনি মোশতাক আহমেদ এবং জিয়াউর রহমানকে ছাড়া। বঙ্গবন্ধুর নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড বাঙালি জাতির জন্য করুণ বিয়োগগাথা হলেও ভয়ঙ্কর সেই হত্যাকাণ্ডে খুনিদের শাস্তি নিশ্চিত না করে বরং দীর্ঘ সময় ধরে তাদের আড়াল করার চেষ্টা হয়েছে। এমনকি খুনিরা জিয়াউর রহমান কর্তৃক পুরস্কৃতও হয়েছে নানাভাবে। যা স্বৈরাচার এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামাত জোট সরকার পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। হত্যার বিচার ঠেকাতে কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি করেছিল বঙ্গবন্ধুর খুনি খন্দকার মোশতাক সরকার আর জিয়াউর রহমান সেটাকে ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে। ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হত্যাকারী গোষ্ঠীর কয়েকজনকে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বিদেশে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হয়েছিল।
মার্কিন সাংবাদিক লিফশুলজ বলেছেন-“কিসিঞ্জার ও সিআইএ এ হত্যাকাণ্ডের উদ্যোক্তা।” ব্রিটিশ সাংবাদিক ক্রিস্টোফার হিচিন্স তার লেখা ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার বইয়ে নথিপত্র দিয়ে প্রমাণ করেছেন, কিসিঞ্জার বাংলাদেশ সফরের সময় মার্কিন দূতাবাসে বসেই ১৫ আগস্টের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ‘গো এহেড’ সিগনাল দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা এবং সামরিক সহযোগিতা সত্ত্বেও শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো এই বিষয়টি নিক্সন-কিসিঞ্জার মেনে নিতে পারেনি। ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণ ছিল ভুট্টো-নিয়াজি এবং পাকিস্তানের সামরিক শক্তির প্রতি স্পষ্টতই চপেটাঘাত। অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক মুসলিম দেশ সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ মেনে নিতে পারেনি। হত্যাকাণ্ডের পর হত্যাকারীরা যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানে খুব সহজে আশ্রয় পেয়েছিল।
১৫ আগস্টের খুনি এবং কুশীলবদের উদ্দেশ্য ছিল একটি আদর্শের হত্যা ঘটানো যে কারণে তারা ব্যক্তি মুজিবকে নয়, মুজিব পরিবার এবং জাতীয় ৪ নেতাকে হত্যা করেছে। তাদের সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি, বঙ্গবন্ধু আজ চিরঞ্জীব, চির অম্লান। আর তাইতো কখনো গুলি হাতে-কখনো গ্রেনেড হাতে খুনিরা বার বার ফিরে এসেছে, চেয়েছে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে ২২ বার হত্যা করতে। কোনো অন্ধকার কানাগলিতে তাদের চক্রান্ত আজও অব্যাহত রয়েছে ।
দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হলে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত করে এবং নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে বিচার সম্পন্ন হয়। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামাত জোট সরকার পাঁচ বছর এই রায় কার্যকরের পথে বাধা সৃষ্টি করে রাখলেও মহাজোট সরকার গঠনের পর ২০০৯ সালে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এবং এখন পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ছয়জনের রায় কার্যকর হয়। দণ্ড প্রাপ্ত কয়েক খুনি আজও বিভিন্ন দেশে পালিয়ে রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সামনের সারির কয়েকজন সৈনিকের বিচার কাজ সম্পন্ন হলেও এর পেছনের কুশীলবদের ভূমিকা আজও অজানা, ইতিহাসের দায় মোচনে এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সকলের নাম উন্মোচিত হওয়া দরকার। কেনেডি হত্যাকাণ্ডের পর যুক্তরাষ্ট্রে ‘ওয়ারেন কমিশন’ হয়েছিল, আমাদের দেশেও কমিশন গঠনের মাধ্যমে সত্য উদঘাটিত হওয়া উচিৎ অন্যথায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন-“সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি।” স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জনসভায় বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন-“কবি গুরু তোমার কথা মিথ্যে হয়েছে আমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।” কিন্তু তাঁকে সপরিবারে হত্যা করার মধ্য দিয়ে কবি গুরুর উক্তিকেই যেন প্রতিষ্ঠিত করা হলো। কবিগুরুর উক্তির যথার্থতা আবার প্রমাণিত হয়ে গেল। বাঙালির পরাজয়ের দিন ১৫ আগস্ট।
[গাজী হাসান মাহমুদ
সদস্য, জাতীয় কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ]