বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!’
ব্রিটিশ ও তাদের অনুগত শাসকদের প্রায় দু’শ বছরের অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়নে জর্জরিত জাতিকে শোষণের বিরুদ্ধে দাড়ানোর উৎসাহ যুগিয়ে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ যুগিয়েছিলেন আমার প্রাণের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি রচনার মাধ্যমে কাজী নজরুল ইসলাম পরাধিন ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে লেখনির মধ্য দিয়ে কঠোর জবাব দিয়েছিলেন। সাথে নিজেও ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত হয়ে পড়েন। ব্রিটিশ বিরোধী পরাধীনতার শৃংখল ভেঙ্গে ভারতের তরুণ সমাজকে স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়তে উৎসাহ যুগিয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। জীর্ণশীর্ণ ও দু’শ বছরের একটি পরাধীন জাতিকে একটি স্বাধীন ও শোষণমুক্ত সমাজ গঠনে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ভূমিকা অত্যান্ত গূরুত্বপূর্ণ।
০২. জাতি সত্ত্বার কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে পাকিস্থানের করাচি থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন। কলকাতায় এসেই সর্বপ্রথম কাজী নজরুল ইসলামের পরিচয় হয় কমরেড মুজাফফর আহমেদের সাথে। পরিচয়ের পর গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠে তাদের মাঝে।
ডিসেম্বরের সেই রাতে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার পর পরদিন কবি কাজী নজরুল ইসলাম সকালে কবিতাটি প্রথম পড়ে শুনিয়েছিলেন তার সঙ্গে থাকা বন্ধু কমরেড মুজফফর আহমেদকে। এ প্রসঙ্গে কমরেড মুজফফর আহমদ তাঁর ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’ বইয়ে বলেছেন, “বিদ্রোহী কবিতা রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে। (যদিও তিনি এর আগে একটি বইয়ে দুর্গাপূজার সময়ে এই কবিতাটি লেখা হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন, তবে এই বইয়ে সেটার সংশোধনী দিয়েছেন)। আর ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রথম ছাপা হয়েছিল ‘বিজলী’ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায়।
সেখানে কমরেড মুজফফর আহমদ আরো লিখেছেন, “তখন নজরুল আর আমি নীচের তলার পূব দিকের, অর্থাৎ বাড়ীর নিচেকার দক্ষিণ-পূর্ব কোনের ঘরটি নিয়ে থাকে। এই ঘরেই কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি লিখেছিল। সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রিতে। রাত্রির কোন সময়ে তা আমি জানিনে। রাত দশটার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে আমি বসেছি, এমন সময় নজরুল বলল, সে একটি কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটি সে তখন আমায় পড়ে শোনাল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা।”
সেইদিনই বেলা হওয়ার পর ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার আফজালুল হক সেই বাড়ীতে আসেন। তাকেও কবিতাটি পড়ে শোনান কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি সেটা শুনে একটি কপি সাথে করে নিয়ে যান।
কমরেড মুজফফর আহমদ লিখেছেন, “আমিও বাইরে চলে যাই। তারপরে বাড়ীতে ফিরে আসি বারোটার কিছু আগে। আসা মাত্রই নজরুল আমায় জানাল যে, ‘অবিনাশদা (বারীন ঘোষেদের বোমার মামলার সহবন্দী শ্রীঅবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য) এসেছিলেন। তিনি কবিতাটি শুনে বললেন, তুমি পাগল হয়েছ নজরুল, আফজালের কাগজ কখন বার হবে তার স্থিরতা নেই, কপি করে দাও, বিজলীতে ছেপে দেই আগে। তাকেও নজরুল সেই পেন্সিলের লেখা হতেই কবিতাটি কপি করে দিয়েছিল।”
০৩. ১৯২২ সালের ৬ই জানুয়ারী শুক্রবার ‘সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায়’ প্রথম ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। বৃষ্টি হওয়ার পরেও কাগজের চাহিদা এতো হয়েছিল যে, সেই সপ্তাহে ওই কাগজটি দুইবার মুদ্রণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন প্রকাশক।
নজরুল গবেষক জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “বাংলা কবিতায় একটা রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের মতো কবিতা লেখা। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের মতো কেউ কেউ সেই বলয়ের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পুরোপুরি বাইরে যেতে পারেননি। প্রমথ চৌধুরী চলতি ভাষা চালু করলেন।” “প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব, ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন, তুরস্কে কামাল পাশার আবির্ভাব, বাংলা সাহিত্যের এসব পটভূমি নজরুলকে ‘বিদ্রোহী’র মতো কবিতা লেখার জন্য প্রভাবিত করেছে।”
বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, “বাংলা সাহিত্য বিশ শতকে রবীন্দ্র প্রভাব এতো সর্বগ্রাসী হয়েছিল, মনে হচ্ছিল, এর বাইরে যাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না ‘বিদ্রোহী’ কবিতার নিশান উড়িয়ে হইহই করে নজরুল এসে হাজির হলেন।”
০৪. ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি বাংলার সমাজ জীবনে, রাজনৈতিক জীবনে, বিভিন্ন আন্দোলনে অত্যন্ত প্রভাব বিস্তার করেছে। এই কবিতা সেই সময় নিষিদ্ধ করা হবে কিনা, সেটা নিয়ে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের মধ্যে অনেক দ্বিধাদ্বদ্ব ছিল। তবে, ব্রিটিশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা না করলেও যেখানেই এসব পত্রিকা পেতো, সেগুলো জব্দ করতো। আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে এক প্রকার নিষিদ্ধ ছিল। বাংলা সাহিত্যে ‘বদ্রোহী’ কবিতা ছাড়া আর কোন কবিতা এত বেশী আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছিল বলে আমার জানা নাই। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার শত বছর পরেও সেই আবেদন এতটুকুও হ্রাস পায় নাই বলেই অভিজ্ঞমহল মনে করে।
‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি যখন কাজী নজরুল ইসলাম রচনা করেন – তখন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিরোধী গান্ধীজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল এবং এক উত্তাল হাওয়া বিদ্যমান ছিল। গোটা ভারতবর্ষে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ছিল। তার এই পরিস্থিতির মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী রচনা ‘বিদ্রোহী’ স্বাধীনতা প্রিয় মানুষের মনে সৃষ্টি করেছিল স্বাধীনতা ঢেউ।
‘বিদ্রোহী’ কবিতার এ পুনঃ পুনঃ প্রকাশনা তখনকার সময়ে পাঠক ও প্রকাশকের মধ্যে এর তুমুল জনপ্রিয়তার প্রমাণ বহন করে। একই বছর এটি মাসিক ‘প্রবাসী’ এবং মাসিক ‘বসুমতী’ এবং পরের বছর ১৩২৯ বঙ্গাব্দে মাসিক ‘সাধনা’য় পুনঃ প্রকাশিত হয়।
কবি যে বাড়ীতে বসে এই কবিতাটি রচনা করেছেন অর্থাৎ কলকাতা ৩/৪ সি, তালতলা লেন, কলকাতা-১৪ বাড়িটি ছিল তখন ‘রাজেন্দ্র কুঠির’ নামে। পরে মালিকানা পরিবর্তন হয়ে হয় ‘সীমা সাহার বাড়ি’। বর্তমানে ‘নজরুল স্মৃতি কক্ষ’ হিসেবে পরিচিত সেই কক্ষটি।
০৫. ১৯২৯ সালে ১৫ই ডিসেম্বর কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ‘বিদ্রোহী’ কবি বা জাতীয় কবি হিসেবে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছিল। সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু এবং সভাপতি ছিলেন ভারতের তৎকালীন বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। সভায় মানপত্রটি দান করেন মি. এস. ওয়াজেদ আলি। প্রসঙ্গত: এটা স্বীকার করতেই হয় যে, ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্ম বাংলা সাহিত্য ও বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাসে এই উজ্জল মাইল ফলক।
অভিনন্দনের উত্তরে কবি কাজী নজরুল ইসলাম নিম্নলিখিত প্রতিভাষন দান করেন। কাজী নজরুলের অনন্য প্রতিভাষন সকলকে মুগ্ধ করে। নজরুল এখানে তাঁর সম্পর্কে ব্যবহৃত ‘বিদ্রোহী’ বিশেষণটি সম্পর্কে নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করেন, “আমাকে বিদ্রোহী বলে খামকা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ-কেউ। এ নিরীহ জাতটাকে আঁচড় কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কেনদিনই নেই। তাড়া যারা খেয়েছে, অনেক আগে থেকেই মরণ তাদের তাড়া করে নিয়ে ফিরছে। আমি তাতে এক-আধটু সাহায্য করেছি মাত্র।”
কাজী নজরুল বলেছেন, “বিদ্রোহী-র জয়-তিলক আমার ললাটে অক্ষয় হয়ে গেল আমার তরুণ বন্ধুদের ভালোবাসায়। একে অনেকেই কলঙ্ক-তিলক বলে ভুল করেছে, কিন্তু আমি করিনি। বেদনা-সুন্দরের গান গেয়েছি বলেই কি আমি সত্য-সুন্দরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি ? আমি বিদ্রোহ করেছি বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন-পচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে, ধর্মের নামে ভন্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। হয়তো আমি সব কথা মোলায়েম করে বলতে পারিনি, তলোয়ার লুকিয়ে তার রূপার খাপের ঝকমকানিটাকেই দেখাইনি-এই তো আমার অপরাধ। এরই জন্য তো আমি ‘বিদ্রোহী’। আমি এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি, সমাজের সকল কিছু কুসংস্কারের বিধি-নিষেধের বেড়া অকুতোভয়ে ডিঙিয়ে গেছি, এর দরকার ছিল মনে করেই।”
০৬. পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দি থাকা, ব্রিটিশরাজের অনুগ্রহ ও করুনা প্রত্যাশী বাঙালি জাতিকে কাজী নজরুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মাধ্যমে ভীষণভাবে আন্দোলিত করেতে পেরেছিলেন। বিশেষ করে স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী বাঙালি তরুণ সমাজের কাছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ছিল রক্তে উন্মাদনা সৃষ্টিকারী, হৃদয়ে অগ্নি-প্রজ্বলনকারী এক বজ্রকঠিন ধ্বনি।
পরিমল গোস্বামী তার ‘আমি যাঁদের দেখেছি’ রচনায় বলেছে, “অত্যাচারীর বিরুদ্ধে এমন ভাষায় আর কোন বাঙালি কবি চ্যালেঞ্জ জানাননি। সমাজের উৎপীড়নে এমন শপথ আর কারো মুখে তা শুনিনি। গঁংঃ ভরমযঃ ঃড় ঃযব ভরহরংয মন্ত্রে দীক্ষিত আর কোন বাঙালি কবি শত্রুপক্ষকে এমন আহ্বান জানাননি।”
পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, “ ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি একসঙ্গে ‘মোসলেম ভারত’ ও ‘বিজলী’-তে প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই নজরুলের খ্যাতিতে বাঙালি সমাজ একেবারে টগবগ করে উঠলো। তরুণ সমাজ তো ‘বিদ্রোহী’র ভাষায় বাক্যালাপ শুরু করে দিলো। সকলের মধ্যে সেই মনোভাব ‘আপনারে ছাড়া কাহারে করি না কুর্নিশ’।”
‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তর সাধক ঃ সাহিত্যচর্চা’ বুদ্ধদেব বসু বলেন, “ কৈশোরকালে আমিও জেনেছি রবীন্দ্রনাথের সম্মোহন, যা থেকে বেরোবার ইচ্ছেটাকেও অন্যায় মনে হত-যেন রাজদ্রোহের সামিল; আর সত্যেন্দ্রনাথের তন্দ্রাভরা নেশা, তার বেলোয়ারি আওয়াজের জাদু-তাও আমি জেনেছি। আর এই নিয়েই বছরের পর বছর কেটে গেল বাংলা কবিতার; আর অন্য কিছু চাইলোনা কেউ, অন্য কিছু সম্ভব বলেও ভাবতে পারলনা-যতদিন না ‘বিদ্রোহী’ কবিতার নিশান উড়িয়ে হৈ-হৈ করে নজরুল ইসলাম এসে পৌঁছলেন। সেই প্রথম রবীন্দ্রনাথের মায়াজাল ভাঙলো।” ‘বিদ্রোহী’ দেখবামাত্র নজরুলের ভেতরে আমি হুইটম্যান আর রবীন্দ্রনাথ দুজনকেই একসঙ্গে পাকড়াও করেছিলাম। তবুও বুঝেছিলাম লেখক বাপকা-বেটা বটে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম কুরুক্ষেত্রের পরবর্তী অন্যতম যুগ-প্রবর্তক বাঙ্গালীর বাচ্চা নজরুল।’ (সাক্ষাতকার: বিনয় সরকার, ৬ জুন ১৯৪৩, বিনয় সরকারের বৈঠকে, প্রথম ভাগ, কলকাতা, ২০০৩, পৃ-৩৯৯)
০৭. ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ হবে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী রচনা ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ১০৩বর্র্ষ পূর্তি। এসময় আমাদের মনে রাখতে হবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সৃষ্টিশীল দুঃসাহসী। নজরুল নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন পরার্থে। স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে জনগণ ও সমাজের জন্য কাজ করেছেন। তার স্বপ্নের যায়গায় সাধারণ মানুষ। কিন্তু বর্তমান সমাজে সবার মাঝে দেখা যায় আত্মসাৎ প্রবণতা। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে এখান থেকে বের করে আনতে হবে। আর কাজী নজরুলের চেতনা আমাদেরকে বুঝতে হবে এবং ধারন করতে হবে। নজরুলকে জানতে হবে, নজরুলের দেশপ্রেম বুকে ধারণ করতে হবে। নজরুলের সৃষ্টিশীল কর্মকান্ড, নজরুলের জীবন দর্শন, জীবন আদর্শ কতোটুকু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। নজরুল রাজনৈতিক-সচেতন ছিলেন, কিন্তু ধর্মের রাজনীতিকরণ এবং ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মধ্যযুগীয় উম্মাদনায় সামিল হননি। তাঁর রাজনৈতিক চেতনার পুরোটাই ছিল মৌলবাদের বিরোধিতা; অসাম্প্রদায়িক সেক্যুলার ও সাম্যবাদী রাষ্ট্রের প্রতি ছিল তাঁর আজীবন পক্ষপাত।
০৮. ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির স্বাধীকারের সংগ্রাম ও অগ্রযাত্রায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা এ দেশের মানুষকে ‘শির উঁচু করে’ চলতে শিখিয়েছে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা যদি রচয়িত না হত, আমরা বিদ্রোহী হতে পারতাম না। ঘুমন্ত বাঙালিকে এই ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মাধ্যমে কবি কাজী নজরুল ইসলাম জাগিয়েছিলেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে কাজী নজরুল ইসলাম আমাদেরকে যেভাবে শির উঁচু করতে শিখিয়েছে, বিদ্রেহী হতে শিখিয়েছে, এ রকম আর কোনো কবি তা পারেননি। ধূমকেতূর কাঁধে চড়ে, বিদ্রোহীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বাঙালি সাহিত্যে এসেছিলেন। এটা অভাবনীয় যে, মাত্র একুশ বয়সে তিনি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতা তিনি রচনা করে গেলেন। কবি এক রাতে একটি কাঠ পেন্সিল দিয়ে অসাধারণ একটি কবিতা রচনা করলেন, যা বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতারূপে প্রকাশিত হয়েছে। তখনকার সময় যুব সমাজ এ কবিতার মাধ্যমে আন্দোলিত হয়েছিল, সব দলে দলে তারা স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। সেই সময় সকল বাঙালিকে অত্যাচার, অবিচার ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য এই বিদ্রোহী কবিতা সাহস জুগিয়েছিল। তখনকার ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যেভাবে সকল অনুপ্রাণিত করেছিল, আজও তেমনিভাবে আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আবেদনকে সময়ের গন্ডিতে বাধা যাবে না। এটা কালজয়ী কবিতা। যতদিন বাঙালি আছে, সংগ্রাম আছে, অত্যাচার ও অত্যাচারিত মানুষ আছে, নিপীড়িত মানুষ, ততদিন বিদ্রোহী কবিতা আমাদের সঙ্গে থাকবে।
E-mail : gmbhuiyan@gmail.com