||মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার||
সৃষ্টি সমাজবদ্ধ। একটির প্রয়োজনে আরেকটি হয়। সেই শুরু থেকেই, চলছে। এভাবেই কালের বিবর্তনে আমরা এই আধুনিক রূপে। রূপ বাড়ছেই। সময়ও বাড়ছে। এদিকে সৃষ্টি ভিত নিচ্ছে।
সৃষ্টি ও সমাজ একসঙ্গে যায়। আর সমাজ প্রসঙ্গ এলে সামাজিকতার প্রসঙ্গও আসে। সামাজিকতার দায় আসে। দায়ের ভিন্নতাই রূপ সংহার। সৃষ্টি, সমাজ, সামাজিকতা, দায় ইত্যাকার শব্দের আবির্ভাব তাই পরস্পর লগ্ন।
সৃষ্টি রূপ পায় কবি-সাহিত্যিকে। কারণ তারা রূপকার। আর এতসব ক্রিয়াকর্মের গতিবিধিও ভাবায়; ভাবনার ফলন ব্যাপ্তিতে তাদেরই অধিকারে। স্বভাবত কবি-সাহিত্যিকদের ভিন্ন আমেজের হতে হয়। ফলন বা ব্যাপ্তি দ্রুততর করতে হয়। ভিন্নতর হওয়ার অবকাশ নেই। তখন দায়বোধ থাকে না। আর দায়বোধহীন কেউ কবি-সাহিত্যিক হন না। নামধারী হতে পারে। এ ভিন্ন বিষয়। কখনোই মূল বিষয় নয়। মূলেই যে কবি-সাহিত্যিকের নাড়াচাড়া।
কবি-সাহিত্যিক কালের অক্ষরে লেখেন। তাই তাকে মূল নিয়েই খেলতে হয়। সুন্দর খেলা। অসুন্দর কখনোই নয়।
কবি-সাহিত্যিক যুগ, কাল বা সমাজের সুন্দর কী বিষয় নিয়ে খেলেন; আর তা সমাজের কী উপকারে আসে এমন প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খেত সেই বালকবেলায়। সময় ও প্রিয় পরশ শেখাল কবি-সাহিত্যিকদের ভাবনাই পৃথিবীর পুঁজি, যাবতীয় সৃষ্টির খাদ্য। যুগে যুগে সামাজিক শ্রেণি-সংগ্রামের অমর যত কাহিনী তা-ই বলে।
কবি-সাহিত্যিকের তাই সামাজিক দায় বেশি। তারা তা পালনও করেন। ব্যতিক্রম কখনো ধর্তব্য নয়। তবে ব্যতিক্রম বা ব্যত্যয় ঘটে বলেই প্রসঙ্গের অবতারণা। পৃথিবীর বা সৃষ্টি রহস্যের ব্যত্যয়েই যত কথোপকথন।
কবি-সাহিত্যিকদের শির থাকতে হয় উন্নত। অন্যের চোখে নয়, নিজের বিবেকে। না হয় কীভাবে তিনি মহান বুলি আওড়াবেন? আর বুলি যদি মহান না হয়, তা সৃষ্টি-সমাজ-সামাজিকতা কোনোটারই সহায়ক হবে না। বরং ক্ষতি করবে। তাই কবি-সাহিত্যিকদের বিকিয়ে গেলে হবে না। এ ক্ষেত্রে প্রকৃষ্ট উদাহরণ কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি কালের অক্ষরে মহান কথামালা রেখে যেতে পারতেন না যদি মাথা বিকিয়ে দিতেন।
কবি-সাহিত্যিকদের নিজের কাছে নিজে পরিষ্কার থাকতে হয়, স্বচ্ছ হতে হয়। মানুষ, সমাজ বা সময় কী ভাবল, তা ভাবার অবকাশ তাদের রাখতে নেই। একসময় দেখা যায় কবি বা সাহিত্যিক যা ভেবেছেন, তা-ই ফলেছে। এতেই সামাজিকতার মহান দায় পালন হয়।
কথা আসে; কথা থাকে-সব কবি-সাহিত্যিক কি সামাজিক দায় পালন করেন বা করছেন? অবশ্যই নয়। যারা করছেন না, তারা বিকিয়ে যাওয়া! আর বিকিয়ে তো কোনো কিছু অর্জন হয় না। আপাত-অর্জন ব্যক্তিটির হতে পারে। এতে তিনি নিজেও নিজের কাছে, সময়ের কাছে হেরে যান। ফলে এমন চরিত্রে কি আর বেরোবে কালজয়ী অক্ষর!
অন্য কথায়, বিকিয়ে যাওয়া কবি-সাহিত্যিক কি নিজে নিশ্চিত করে বলতে পারবেন তিনি মহান কিছু লিখেছেন? ঠুনকো পাওয়ার আশায় তো তিনি বিকিয়েই গেছেন। মহান কিছু কি তখন আর বেরোনোর উপায় আছে? মহান কিছু বের হওয়া বা জমা থাকার আধার হয়ে ওঠা কি এত সহজ!
কবি-সাহিত্যিক গভীরে চোখ রাখেন, জন্ম থেকেই তাদের এই বিশেষ ক্ষমতা। কিন্তু কথা থাকে-বিশেষ এ চোখের সঠিক ব্যবহার হওয়া চাই। কালের বিচারে শ্রেষ্ঠত্বের আসন পাওয়ার জন্য। যদি এ চোখের ব্যবহার হয় ব্যক্তিস্বার্থে, তবে যা হওয়ার তা-ই হবে! কোনো কিছুই পাওয়া হবে না। বরং মাঝপথে অনেক কিছুই হারাতে হবে। আবার হতে পারে, ব্যক্তিটির আপাত লাভ হবে। কিন্তু গূঢ় অর্থে ভাবলে, ক্ষতিই বেশি হবে। নিজেই যিনি নিজের এমন ক্ষতি করেন, তিনি ভালো মানের বা মনের কবি-সাহিত্যিক নন। এ দুটির কোনো একটি ছাড়া তার দ্বারা সামাজিক দায় কতটুকু রক্ষিত হবে, ভাবনার বিষয়!
সামাজিক দায় রক্ষার বিপরীতে ওই মুহূর্তে তাদের দ্বারা সামাজিক ভারসাম্যই বেশি নষ্ট হবে। তারা হতে পারতেন সমাজের কল্যাণে, সমাজের চোখে বিশেষ কিছু। তা না করে ভাবনার ভুলে তারা হলেন সমাজের ও সময়ের বিষ্ঠা। শুধুই কি সমাজ? তারা স্বগোত্রেরও ক্ষতির কারণ!
কবি-সাহিত্যিকদের জ্ঞানের অভাব নেই। মুদ্রার উল্টো পিঠে তাদের অজ্ঞানেরও সীমা-পরিসীমা নেই। তো এমন অজ্ঞানে সমাজের-রাষ্ট্রের-ব্যক্তির-গোত্রের ক্ষতির কারণই বেশি। তাই তাদের পৃথিবীতে বিচরণের সময় কালের অক্ষরে উল্টো লেখা হয়। যা হতো মহান; তা হয় অন্য রকম। কেমনতর তা-যারা এ দোষে দুষ্ট, তারা ভালোই জানেন!
এরপরও কবি-সাহিত্যিক সমাজে অনেক কিছুর প্রতিনিধি হয়ে আসেন। তারা সংখ্যায় খুব বেশি আসেনও না। তাই তাদের হতে হয় তেমনই। যোগ্যতায়, মনে, মননে, স্বপ্নে, ভালোর ইচ্ছায়।
ব্যক্তিগত মত, একজন কবি বা সাহিত্যিককে হতে হয় যুগের দর্পণ, সময়ের দর্পণ, এমনকি মানুষেরও। তারাই যে মানুষ, সমাজ ও অনেক কিছুর নিয়ন্তা।
লেখক:-: বাংলাদেশ জ্ঞান সৃজনশীল প্রকাশক |•| ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: বাংলা পোস্ট |•| __ও বিশেষ প্রতিবেদক দৈনিক নয়াদেশ |•|