পবিত্র রমজান মাস ঘরে আসার দিনকতক আগেই বাজারে পণ্য মূল্যের পারদ উর্ধ্বমুখি হয়ে উঠে। ব্যবসায়ীরা মজুদদারির কথা অস্বীকার করলেও বাজারে বাণিজ্য মন্ত্রীর নির্দেশ কেহ মানছেনা। নারায়ণগঞ্জে বাজারগুলোতে রমজান নির্ভর পণ্যের দাম বাড়তি।
বিপদে পড়ে বাধ্য হয়ে মানুষ বাড়তি দামে জিনিসপত্র কিনছে। ব্যবসায়ীদের মুখে সেই পুরনো বুলি ‘বেশি দামে কেনা বেশি দামে বিক্রি। আমাদের কিছু করার নেই’। সাধারণ মানুষের পক্ষে পণ্যের আমদানি মূল্য জানার কোন উপায় না থাকায় ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে সাধারণ মানুষের পকেট কাটে বৈধ পন্থায়।
দেশে করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও চাহিদার চাইতেও বেশি মজুদ আছে রমজান নির্ভর পণ্যসহ অন্যান্য নিত্যপণ্য। এরপরও আগের বছরগুলোর মতো এবারও রমজানকে ঘিরে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অতি মুনাফা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
ইতোমধ্যে তারা কারসাজি করে চাল, ডাল, ছোলা, বেসন, চিনি, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, মরিচ, আদা-রসুন ও সব ধরনের মাংসসহ খেজুর ও একাধিক ফলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
এসব পণ্য কিনতে রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠছে ক্রেতাদের। ফলে বাড়তি দরেই শুরু হল রমজান। বৃহস্পতিবার সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, গত ১ মাসের ব্যবধানে খুচরা বাজারে কেজিতে মসুরের ডালের (মোটা দানা) দাম বেড়েছে ৩১ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।
মাঝারি দানা মসুরের ডালের দাম বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। কেজিতে অ্যাংকর ডালের দাম বেড়েছে ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। আর প্রতিকেজি ছোলা ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। টিসিবি সূত্র আরও বলছে, ভরা মৌসুমেও মাসের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১০ শতাংশ বেশি দরে।
আর কেজিতে আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ বেশি দরে। কেজিতে রসুনের দাম বেড়েছে ৪১ দশমিক ১৮ শতাংশ। শুকনা মরিচের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ। মাসের ব্যবধানে কেজিতে আদা বিক্রি হচ্ছে ১১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি দরে।
এছাড়া কেজিতে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ। প্রতিকেজি চিনির দাম বেড়েছে ৩ দশমিক ৭০ শতাংশ। আর মাসের ব্যবধানে খেজুরের দাম বেড়েছে ৯ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ।
এদিকে করোনা পরিস্থিতি ও রমজানে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বাজার তদারকিতেও সরকারের একাধিক সংস্থা মাঠে কাজ করছে। সঙ্গে সারাদেশে টিসিবির মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রি কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য বছরের তুলনায় টিসিবি এবার দশগুণ বেশি পণ্য বিক্রি করছে।
যা রমজানের পরও অব্যাহত রাখবে। সরকারে এত উদ্যোগের পরও এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়েই যাচ্ছে। এছাড়া টিসিবির পণ্য কালোবাজারে বিক্রি করার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যেমন চাল, ডাল, তেল, ছোলা, পেঁয়াজ, রসুন ও আদাসহ সব পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। এ মজুদের পরিমাণ চাহিদার তুলনায় বেশি।
কোনো পণ্যের ঘাটতি হওয়ার সম্ভাবনা বা কারণ নেই। কৃত্রিম উপায়ে কোনো পণ্যের সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করা হলে সরকার তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আসন্ন পবিত্র রমজান উপলক্ষে এবং বর্তমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদন, মজুদ, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
এ সভাতেই বাণিজ্যমন্ত্রী আরও জানান, পবিত্র রমজান মাসের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ আগে থেকেই বাড়ানো হয়েছে। দেশীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের চাহিদার তুলনার অধিক পণ্য উৎপাদন করেছে।
আমদানিযোগ্য পণ্য অনেক আগেই পর্যাপ্ত পরিমাণে আমদানি করা হয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু পণ্য পরিবহন এবং আমদানিকৃত পণ্য দ্রুত খালাসের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কোনো পণ্যেরই সংকট নেই এবং মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা বা কারণ নেই।
সংশ্লি¬ষ্ট সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্বশীল হয়ে দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে। সব পণ্যের সরবরাহ ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে গঠিত টাস্কফোর্স এবং বিভিন্ন কমিটিকে আরও তৎপর হয়ে কাজ করতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তথা সরকার প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করবে।
তিনি জানান, বর্তমানে সারাদেশে ৯০টি বাজার মনিটরিং টিম নিয়মিত বাজার মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এছাড়া টিসিবির কার্যক্রম মনিটরিং করার জন্য ঢাকাতে ৮টি এবং ৬৪ জেলায় জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে সরকার অভিযান জোরদার করেছে। আশা করা যায়, কোনো সমস্যা হবে না।
তবে গতকাল নগরীর কালীরবাজার, দ্বিগুবাবুর বাজার ও মাসদাইর বাজার কাঁচাবাজার ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে, এদিন প্রতিকেজি ছোলা বিক্রি হয়েছে ৮০-৮৫ টাকা। যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৭০-৮০ টাকা। বড় দানা মসুরের ডাল বিক্রি হচ্ছে ৯০-১০০ টাকা। যা ১ মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৭০-৭৫ টাকা।
মাঝারি আকারের মসুর ডাল প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৪০ টাকা। যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৭৫-৮৫ টাকা। অ্যাংকর ডাল বিক্রি হয়েছে ৪০-৪৫ টাকা কেজি। যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৩৫-৪০ টাকা। প্রতিকেজি পেঁয়াজ মান ভেদে বিক্রি হচ্ছে ৪০-৫০ টাকা। যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৪০-৪৫ টাকা।
রসুন বিক্রি হচ্ছে ১০০-১২০ টাকা। যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৭০-১০০ টাকা। প্রতিকেজি দেশি আদা বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা। যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ১১০-১২০ টাকা। চিনি প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৭৫ টাকা। ৬৫-৭০ টাকা। প্রতিকেজি মাঝারি মানের খেজুর বিক্রি হচ্ছে ২৫০-৩৫০ টাকা।
যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ২৫০-৩০০ টাকা। এছাড়া খোলা সয়াবিন তেল প্রতিলিটার বিক্রি হয়েছে ১০০ থেকে ১১০ টাকা। যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৯০-৯২ টাকা। আর দেড় মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৮৮-৯০ টাকা।
মাসদাইর বাজারের মুদি ব্যবসায়ী সাবিত আলম বলেন, রমজান ঘিরে সব পণ্যের দাম বেশি। পাইকাররা গত দুই মাস থেকে ধীরে ধীরে সবগুলো পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। সর্বশেষ গত সপ্তাহের তুলনায় নতুন করে রমজান নির্ভর পণ্য-ছোলা, ডাল, চিনি, ভোজ্যতেল, আদা, রসুন ও পেঁয়াজের দাম বাড়িয়েছে। যে কারণে বাড়তি দরে এনে বাড়তি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে।
জানতে চাইলে নগরীরর পাইকারি আড়ত নিতাইগঞ্জের একজন আমদানিকারক বলেন, করোনার প্রভাবে চট্টগ্রাম বন্দরে অনেক পণ্য আটকে আছে। যা খালাস করা যাচ্ছে না। যে কারণে আদা, রসুনসহ একাধিক পণ্যের সরবরাহ ঘাটতির কারণে দাম বেড়েছিল।
এছাড়া করোনা পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে উৎপাদিত পণ্য পরিবহন সংকটে কিছু আসতে দেরি করায় একাধিক পণ্যের দাম বেড়ে গিয়েছিল। তবে সরবরাহ বাড়তে থাকলে দাম কমে যাবে।
নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সভাপতি এবি সিদ্দিক বলেন, রমজানে পণ্যমূল্য ভোক্তা সহনীয় করতে মনিটরিং আরও জোরদার করতে হবে। কোনো ধরনের কারসাজি করলে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সঙ্গে ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে।
একসঙ্গে এক মাসের বাজার থেকে বিরত থাকতে হবে। এতে বাজারে পণ্যের ঘাটতি থাকবে না। আর ঘাটতি না থাকলে অসাধুরা কারসাজি করতে পারবে না।