এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া:
৫ অক্টোবর, ২০২০ বিচরপতি আবদুস সাত্তারের ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। কে এই বিচারপতি সাত্তার ? কারো মনে আছে কি ? অনেকেরই মনে নেই তার নাম। তার মৃত্যুবার্ষিকীর দিনটা। এমন কি যে দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এমন কি চেয়ারম্যানও ছিলেন সেই দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিও তাকে ভুল করে স্মরণ করে বলে জানা নাই আমার। অন্যকারো জানা থাকেত পারে।
বিএনপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, জিয়াউর রহমান পরবর্তী দলের চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। তারই অধিনে ভাইস চেয়ারম্যান হিসাবেই বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতি শুরু। একসময় বিচারপতি আবদুস সাত্তার দল থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলে বেগম খালেদা জিয়া ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও পরবর্তীতে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন হঠাৎ করে আমি কেন বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে নিয়ে লিখছি ? উত্তরটা হলো – রাজনৈতিক অঙ্গনে দীর্ঘদিন একজন কর্মী হিসাবে লক্ষ্য করছি রাজনৈতিক দলগুলো সকল সময়ই একে অপরের চরিত্র হননের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে। বিএনপি প্রায় সখর নেতাই অভিযোগ করে থাকে আওয়ামী লীগ অকৃজ্ঞদল। তারারা তাদের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাসানী সহ অন্যান্যদের ভুলে গেছে। সেখান থেকেই আমার মনে প্রশ্ন দেখা দিলো বিএনপি তাহলে কি কৃতজ্ঞদের দল ? নাকি বিএনপিও অকৃতজ্ঞদের কাতারেই তাদের অবস্থান রেখেছে। আওয়ামী লীগ তাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পোষ্টারে, দলীয় কাউন্সিলে দলের প্রতিষ্ঠাতা মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দিয়ে থাকে। বিএনপি কি জিয়াউর রহমান পরবর্তী চেয়ারম্যান বিচারপতি আবদুস সাত্তারের ছবি কোথাও ব্যাবহার করেছে ? আমার জানা নাই। অবশ্য আমার মত একজন অজ্ঞর তা জানারও কথা নয়। বিএনপির দলীয় ওয়েব সাইডে জিয়ার পর বেগম জিয়া আছেন কোথাও সাত্তার আছেন বলে দেখি নাই। তাহলে আসলে কি দাড়ালো ? সবচাইতে বেশী অকৃতজ্ঞ কারা ? বিচারপতি আবদুস সাত্তার, মশিউর রহমান যাদু মিয়া না হলে কি বিএনপি হতো ? যাদু মিয়ার ধানের শীষ নিয়ে আজ কারা ব্যবসা বাণিজ্যে নিয়োজিত ? এই প্রশ্নগুলোর সমাধাণ খুজি আমি।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার ১৯০৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুরের দাড়কা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৮ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ এবং ১৯২৯ সালে বি.এল ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি কলকাতা জজকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। এসময় তিনি এ.কে ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টিতে যোগ দেন। আবদুস সাত্তার ১৯৪১ সালে কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করেন। তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের কাউন্সিলর (১৯৩৯), কলকাতা ইম্প্রুভমেণ্ট ট্রাইব্যুনালের অ্যাসেসর-মেম্বর (১৯৪০-৪২) এবং কলকাতা কর্পোরেশনের মুখ্য নির্বাহি কর্মকর্তা (১৯৪৫) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ভারত বিভক্তির পর আবদুস সাত্তার ঢাকায় এসে (১৯৫০) ঢাকা হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করেন। এ.কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে ১৯৫৩ সালে কৃষক-শ্রমিক পার্টি গঠিত হলে তিনি তাতে যোগ দেন। তিনি ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং আই.আই চুন্দ্রিগড়ের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র ও শিক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন (১৯৫৭)। আবদুস সাত্তার ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি এবং ১৯৬৮-৬৯ সালে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ছিলেন। তিনি ১৯৬৯-৭২ সালে পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বিচারপতি সাত্তার ১৯৭৩ সালের শেষদিকে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আসার পর বিভিন্ন সরকারি দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ জীবনবীমা কর্পোরেশনের পরিচালক মন্ডলীর চেয়ারম্যান (১৯৭৩-৭৪), সংবাদপত্র বেতন বোর্ডের চেয়ারম্যান (১৯৭৪-৭৫) এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল’ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স-এর চেয়ারম্যান ছিলেন।
বিচারপতি আবদুস সাত্তার ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের বিশেষ উপদেষ্টা নিযুক্ত হন এবং আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলের (জাগদল) আহবায়ক ছিলেন বিচারপতি সাত্তার। কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি এ দল বিলুপ্ত ঘোষণা করে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে নবগঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সহ-সভাপতি পদে যোগদান করেন।
১৯৮১ সালের ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হলে তিনি দেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৮১ সালে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারম্যান হন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাপ্রধান হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ কর্তৃক এক সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার ক্ষমতাচ্যুত হন। ১৯৮৫ সালের ৫ অক্টোবর তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
জিয়াউর রহমান হত্যার পর অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী বিচারপতি আবদুস সাত্তার জয়লাভের পর ১৯৮১ সালের ২০ নভেম্বর শপথ গ্রহণ করেন। নতুন সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার এক মাস যেতে না যেতেই সেনাবাহিনী প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সেনা সদরে সাংবাদিকদের ডেকে পাঠান। অনেকটা সংবিধান বহির্ভূতভাবেই সেনাপ্রধান সাংবাদিকদের একটি বিবৃতি ধরিয়ে দেন। বিবৃতিতে তিনি ক্ষমতায় সশস্ত্র বাহিনীর অংশীদারিত্ব দাবি করেন। জেনারেল এরশাদের বিবৃতি থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিচারপতি সাত্তারের সরকার দিয়ে জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক বিদ্রোহের অভিযোগ এনে ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে ফাঁসি দেয়া হয়। ভিতরে-বাইরে অনেকের বিশ্বাস তাঁদের অনেকেই নির্দোষ ছিলেন। একদিকে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভয় এবং অন্যদিকে বিচারপতি সাত্তার সরকার বিশেষ করে খালেদা জিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই দ্রুত সামরিক বিচারের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো।
তার সরকারেরও ছিল দুর্বল। বিএনপির ভেতরও তখন মতবিরোধ দেখা দেয়। দুর্নীতি পরিলক্ষিত হচ্ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে যুব প্রতিমন্ত্রী আবুল কাসেমের সরকারি বাসভবন থেকে কুখ্যাত সন্ত্রাসী ও আসামী ইমদুকে গ্রেফতার করা হয়। এই ঘটনা সাত্তার সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদ দ্বিতীয়বারের মত বাংলাদেশে সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা গ্রহণ এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। জেনারেল এরশাদ ঘোষণা দেন, বিচারপতি আব্দুস সাত্তার স্বেচ্ছায় ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এই মর্মে বিচারপতি আব্দুস সাত্তার টেলিভিশনে একটি ছোট্ট বিবৃতিও প্রদান করেন। অবশ্য পরে তিনি নানাভাবে বলেন যে, তাকে বিবৃতি দিতে বাধ্য করেছিলেন। (সূত্র : এরশাদের ক্ষমতা দখল, কামাল হায়দার, দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা ২৪ মে ১৯৯৭)
বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হওয়ার আগেই রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের সঙ্গে সংঘাতে গিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর কারণে বিএনপির চেয়ারপারসনের শূন্য পদে উভয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য খালেদা জিয়া পিছু হটেন। তিনি ভাইস চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এইচএম এরশাদ সামরিক শাসন জারি করে ফের অসাংবিধানিক শাসনের পথে দেশকে ঠেলে দেওয়ার পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার বিএনপির দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান এবং দলের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার সরাসরি রাজনৈতিক দৃশ্যপটে আগমনের পথ খুলে যায়। আর সে কারণেই হয়তো বিচারপতি সাত্তারের ইন্তেকালের পর থেকে আজ পর্যন্ত বিএনপি আর বিচারপতি সাত্তারকে স্মরণ করেন নাই বা করতেও চান না।
তাহলে বিএনপির পক্ষ থেকে অকৃতজ্ঞতার যে অভিযোগের তীর আওয়ামী লীগের দিকে নিক্ষেপ করা হয় তা কি সত্য ? নাকি বরং নিজেদের অকৃতজ্ঞ চেহারাটা আড়াল করতেই রাজনীতির এই নোংরা খেলা।
পরিশেষে বলতে চাই, বিচারপতি আবদু সাত্তারের রাজনৈতিক কোন অনুসারী বা অনুরাগী আমি নই। তবু তাকে স্মরণ করে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলতে চাই বিচারপতি আবদুস সাত্তার কেউ মনে রাখেনি তোমায়। দলে জন্মের বেদনা সাথে তুমি যে জড়িত ছিলে তাও ভুলে গেছে তারা। তামাদের ঘামে প্রতিষ্ঠিত প্লাটফর্মও তোমাকে স্মরণ করতে বড় লজ্জা পায়, বড় শরম পায়। কারণ, তাদের অন্যদের অকৃতজ্ঞ বলতে চায় নিজেদের অকৃতজ্ঞ চেহারটাকে আড়াল করার লক্ষ নিয়েই। তারা শুধু চায় আর চায়, আগামীতেও চায়। দিতে চায় না কিছু, এমনকি এতটুকু সম্মান।
[ লেখক : মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন ]