নিজস্ব প্রতিবেদক:
বিএনপির ইতিহাস বিকৃতির কারণেই এখনো ২৫ মার্চের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এমপি।
তিনি বলেন, কেনো স্বীকৃতি পাইনি সেটার কারণ খুঁজতে গেলে দেখতে পাবো, ‘৭৫ এর পর পরাজিত শক্তিরা দেশকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার পায়তারা শুরু করেছিলো। খুনি জিয়াউর রহমান ‘৭১ এর ঘৃণ্য রাজাকারদের নিয়ে সরকার গঠন করে এবং প্রচার করতে শুরু করে, ‘৭১ সালে আসলে তেমন কোনো গণহত্যা হয়নি। সেদিন থেকেই বাংলাদেশ উল্টোপথে হাঁটা শুরু করেছিলো। সেই পথ ধরেই খালেদা জিয়াও রাজাকারদের নিয়ে সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অপমানিত করেছেন, ৩০ লক্ষ শহিদের আত্মত্যাগকে ভূলুণ্ঠিত করেছেন। খালেদা জিয়া তো তার এক কর্মীসভায়ও বলেছিলেন, “৭১ এর যুদ্ধে খুব বেশি মানুষ মারা যায়নি। বড়জোর ২ লক্ষ মানুষ মারা গেছে।”
শুক্রবার (২৫ মার্চ) বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ- ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আয়োজিত এক স্মরণসভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ”২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস” উপলক্ষে এই স্মরণসভার আয়োজন করা হয়।
মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, এখন মির্জা ফখরুলরা বলেন, “আমরা ‘৭১ সালে যুদ্ধ করেছি।” আমার প্রশ্ন হচ্ছে আপনারা কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন? ‘৭৫ এর পর এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠার পরে রাজাকার আল-বদরদের ঐক্যবদ্ধ করে এদেশের সাধারণ মানুষের বিপক্ষে আপনারা যুদ্ধ করেছেন। বিএনপি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় বরং স্বাধীনতার পর তারা এদেশের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করেছে। তারা সেসময় রাজাকারদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়ে এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের কথা বলে।
গণহত্যার শিকার হওয়া পৃথিবীর আরো বেশ কিছু রাষ্ট্রের উদাহরণ টেনে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন বহু গণহত্যা হয়েছে, যেগুলোর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখনো পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪১ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত জাপানীরা হিটলারের সাথে মিলে ৪১ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিলো। ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৯ সালে জেনোসাইড হয়েছিলো। সেখানেও প্রায় ৫ থেকে ১৭ লক্ষ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাৎসি বাহিনি একাই প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে, যা এখনো পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় গণহত্যা হিসেবে পরিচিত। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ সালে কম্বোডিয়ায় প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিলো, দীর্ঘদিন পর ২০১৩ সালে আইন পাশ করে সেটার স্বীকৃতি দেয়া হয়। ১৯১৫ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত আলবেনিয়ায় গণহত্যা হয়েছিলো। সেখানে প্রায় ১০ থেকে ১৮ লক্ষ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিলো, সেটারও স্বীকৃতি আসেনি। রুয়ান্ডায় ১৯৯৪ সালে ১০০ দিনে প্রায় ৮ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিলো। অনেক পরে ২০১৩ সালে সেটার স্বীকৃতি মেলে। বসনিয়ায় ৩ লক্ষ মানুষকে হত্যারও কোন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। পাশের দেশ মিয়ানমারে ১০ হাজার রোহিঙ্গাকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়, স্বীকৃতি কিন্তু আসেনি। সেই একই ধারায় ৩০ লক্ষ বাঙালির গণহত্যারও স্বীকৃতি এখনো আমরা পাইনি।
২৫ মার্চের ভয়াল কালোরাতের হত্যাযজ্ঞের শিকার হওয়া শহিদদের স্মরণ করে তিনি আরো বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার শাসকদের নির্দেশে নিরস্ত্র নিরীহ বাঙ্গালীর উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিলো। হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিলো। শুধু তাই নয়, সম্ভ্রম হারায় অসংখ্য মা-বোন। তাদের অপরাধ ছিলো একটাই, তারা বাঙালি। এরপর জাতির পিতা শেখ মুজিব ২৬ মার্চ ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এরপর ৯ মাস যুদ্ধ করে ৩০ লক্ষ শহিদ ও ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেলাম স্বাধীনতা। কিন্তু ২৫ মার্চ রাতে যে গণহত্যা হলো, সেই হত্যাকাণ্ডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আমরা এখনো পাইনি। ‘৭৫ এর পর বারবার এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছিলো, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছিলো। যার ফলে আমরা এখনো এই গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় করতে পারিনি।
বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করে হানিফ বলেন, ‘৫২’র ভাষা আন্দোলন, ‘৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ‘৬৬’র ৬ দফা, ‘৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০’র নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় লাভের পর বঙ্গবন্ধু ‘৭১ সালের ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। এটিই ছিলো মূলত: বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। সেদিনের পর থেকে পুরো পূর্ব পাকিস্তানের সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ ছিলো বঙ্গবন্ধুর হাতে। তার নির্দেশেই সেদিন থেকেই বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু করে । হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে অপারেশন সার্চলাইটের মত বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালায় ২৫ মার্চ রাতে। সেসব শহিদদের স্মরণেই ২০১৭ সালেই প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা হয় ।
ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমানের সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এমপি। স্মরণসভায় আরো বক্তব্য রাখেন, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী, সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির, উত্তরের সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচি, নগর নেতা জাহানারা বেগম, ডা. দিলীপ কুমার রায়, মাহবুবুর রহমান হিরন, মিরাজ হোসেন, মহিউদ্দিন মহি, মিজানুর রহমান মিজান, গোলাম সারোয়ার কবির, রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ প্রমুখ।