এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া:
ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামের অবিসংবাদিত মহান নেতা ইয়াসির আরাফাতের ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী ১১ নভেম্বর, ২০২০।
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক ইয়াসির আরাফাত, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথিকৃৎ। ছিলেন এক অবিসংবাদিত আরব জাতীয়তাবাদী নেতা। ১৯৬৯-২০০৪ পর্যন্ত প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগেনাইজেশন (পিএলও)’র চেয়ারম্যান ও ১৯৯৪-২০০৪ পর্যন্ত প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল অথরিটি (পিএনএ)’র প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
মিশরের কায়রোতে এক ফিলিস্তিনি পরিবারে ১৯২৯ সালের ২৪ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন ইয়াসির আরাফাত। শৈশবের অধিকাংশ সময়ই তিনি মিশরের কায়রোতে ছিলেন। আরাফাতের পুরো নাম মুহাম্মদ আবদেল রহমান আবদেল রউফ আরাফাত আল-কুদওয়া আল-হুসাইনি। কৈশোরে তিনি ইয়াসির নামে পরিচিত ছিলেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে সমর্থকরা আবু আম্মার নামে সম্বোধন করতে থাকেন। আরাফাত ছিলেন একটি ফিলিস্তিনি সুন্নি মুসলিম পরিবারের সন্তান। তার বাবা আবদেল রউফ আল-কুদওয়া আল-হুসাইনি গাজার এবং মা জোয়া আবুল সাউদ জেরুজালেমের অধিবাসী ছিলেন। মাত্র চার বছর বয়সে মাকে হারান আরাফাত। লেখাপড়া করেছেন মিশরের কিং ফুয়াদ ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে অধ্যায়নরত অবস্থায়ই তিনি আরব জাতীয়তাবাদে আকৃষ্ট হন এবং ইহুদিবাদ বিরোধী আদর্শে প্রভাবিত হন।
১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ভাগ করে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে এর প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের পক্ষে তিনি ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৫২-৫৬ পর্যন্ত ফিলিস্তিনি ছাত্রদের জেনারেল ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন। ইসরাইলকে উৎখাত করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাকে জীবনের ব্রত হিসাবে গ্রহন করে ১৯৫৯ সালে তিনি আধাসামরিক সংগঠন ‘ফাতাহ’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৯ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত তিনি এ দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ দলটি মিশর, জর্ডান, লেবাননসহ বিভিন্ন আরব দেশ থেকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে।
১৯৮৩-৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি তিউনিসিয়ায় ছিলেন এবং সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তে ইসরাইলের সঙ্গে সমঝোতা ও শান্তি আলোচনার চেষ্টা চালিয়ে যান। ১৯৮৮ সালে তিনি ইসরাইল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেন এবং ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংকট নিরসনে ‘দ্বি-রাষ্ট্র’ ভিত্তিক সমাধান নীতির প্রতি সম্মতি দেন। তার নেতৃত্বেই ১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়া হয়। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেয় আলজেরিয়া।
১৯৯৪ সালে তিনি গাজায় বসতি স্থাপন করেন। ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংকট নিরসনের লক্ষ্যে তিনি ইসরাইলের সঙ্গে বেশ কিছু শান্তি আলোচনা ও সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তার নেতৃত্বে ১৯৯৩ সালে ইসরাইল ও পিএলও এর মধ্যে ঐতিহাসিক ‘অসলো চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। স্বাধীন ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি না দিলেও এ চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইল ও পিএলও পরস্পরকে স্বীকৃতি দেয়। এই চুক্তি স্বাক্ষর করায় ১৯৯৪ সালে আইজ্যাক রবিনের সঙ্গে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। তার কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে ১৯৯৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ইসরাইল ও পিএলও এর মধ্যে গাজা ও পশ্চিম তীর সম্পর্কিত অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে গাজা ও পশ্চিম তীরে সীমিত আকারে ফিলিস্তিনের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। রামাল্লাকে রাজধানী করে গাজা ও পশ্চিম তীরের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে পিএনএ। যার প্রেসিডেন্ট হন ইয়াসির আরাফাত।
১৯৯৬ সালের ২০ জানুয়ারি ফিলিস্তিনের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে জয়ী হয়ে আরাফাত ফিলিস্তিনের প্রথম প্রেসিডেন্ট হন। এর পর স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য আরাফাত মরিয়া চেষ্টা করেন। যার অংশ হিসেবে ২০০০ সালের ক্যাম্প ডেভিড সম্মেলনে যোগ দেন তিনি। কিন্তু মার্কিন শান্তি উদ্যোগে আরাফাত বারবার বড় ধরনের ছাড় দিলেও দখলদার ইসরাইল কোনো চুক্তিই বাস্তবায়ন করেনি। তারা ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।
ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে ফাতাহের উত্থানে ফিলিস্তিনে আরেক বিপ্লবী সংগঠন হামাসের প্রভাব কমে আসে। ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকটের দীর্ঘমেয়াদি ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ ২০০২ সালে শান্তির জন্য রোডম্যাপ প্রস্তাব ঘোষণা করে। এ প্রস্তাব প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন ইয়াসির আরাফাত। ইসরাইল কর্তৃক দুই বছর ধরে রামাল্লা অবরোধের সময় ২০০৪ সালের শেষ দিকে ইয়াসির আরাফাতের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে। পরে ২০০৪ সালের ১১ নভেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এই মহান নেতা।
বাংলাদেশের মহান বন্ধু ইয়াসির আরাফাতকে ১৯৭৪ সালে লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্ভাষণ জানান। অবৈধ দখলদারিত্বে অবসান ঘটিয়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা অর্জনকে সমর্থন করা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির স্থায়ী নীতি। এর অংশ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়নি বাংলাদেশ। জীবদ্দশায় ইয়াসির আরাফাত অনেকবার রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় এসেছিলেন। এ ছাড়া ফিলিস্তিনের জন্য সমর্থন আদায়ে বিশ্ব ভ্রমণকালে অসংখ্যবার ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতি করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২৫ বছরপূর্তি উপলক্ষে ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ আমন্ত্রণে ইয়াসির আরাফাত ঢাকায় এসেছিলেন।
বর্তমান বিশ্বে একমাত্র জাতি হলো ফিলিস্তিনীরা, যাদের নিজস্ব ভূমি নেই, সার্বভৌমত্ব নেই। কিন্তু তাদের একজন নেতা বিশ্ববাসী পরিচিত। তিনি হলেন, ইয়াসির আরাফাত। যিনি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ও মহানায়ক। একজন স্বাধীনতাকামী বীর হিসেবে বাংলাদেশেও যার রয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে দল, মত, বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষ ফিলিস্তিনীদের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন জানিয়ে এসেছে। এজন্য কৃতজ্ঞ ফিলিস্তিনীরা আরবের বাইরে বাংলাদেশীদের সঙ্গে একই রকমের বন্ধন অনুভব করে।
ইয়াসির আরাফাত ছিলেন মুসলিম বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতা। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একজন অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। শেখ হাসিনাসহ বাংলাদেশের সকল রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানগণ নিজ নিজ শাসনামলে ফিলিস্তিনী এ মহান নেতার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন অব্যাহত রেখেছেন। ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতিদানকারী ১৩৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
ফিলিস্তিনের সাথে বাংলাদেশ সম্পর্ক অনেকটা জন্মের পর থেকেই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি ইয়াসির আরাফাতকে বাংলাদেশের জনগণ মহান বন্ধুর মর্যাদা দিয়েছে। বাংলাদেশ অন্যান্য মুসলিম দেশের মতো প্রথম থেকেই স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা এসেছেন, তারা সবাই ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন।
শুধু ফিলিস্তিনের নয়, সারাবিশ্বের নিপীড়িত জনগণের মুক্তির প্রতীক এ নেতা ২০০৪ সালের ১১ নভেম্বর ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যু নিয়েও নানান প্রশ্ন রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে তার মৃত্যুর পেছনে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সম্পৃক্ততার খবর প্রকাশ পেয়েছে। এই মহান নেতার ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার প্রতি রইল শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।
[ মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন]