নিজস্ব প্রতিবেদক♦♦
নারীদের সম্ভ্রম থেকে ব্যাংক লুটপাট। এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা করতো না চক্রটি। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক শাসন করেছে এই চক্র। চক্রের অন্যতম হোতা আইএফআইসি ব্যাংকের সাবেক এমডি শাহ আলম সারোয়ার ও তার বন্ধু মো. আরিকুল ইসলাম পিন্টু। চক্রের প্রধান হোতা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা, সাবেক এমপি সালমান এফ রহমান। সালমান এফ রহমানের প্রভাবেই ব্যাংক সেক্টরে অবাধে নানা অপকর্ম করেছে তারা। দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে সিন্ডিকেটটি। তাদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীদের অভিযোগের শেষ নেই।
রাত নামলেই মদ-নারীর আড্ডায় মেতে উঠতো তারা। আড্ডা হতো দেশে-বিদেশে। মূলত ক্লায়েন্টকে সন্তুষ্ট করতে নানা আয়োজন থাকতো শাহ আলম সারোয়ার ও আরিকুল ইসলামের। মধ্য বাড্ডায় অবস্থিত তার মালিকানাধীন ‘মাহাদী এন্টারপ্রাইজ’ এবং ‘মাহাদী সাপোর্ট সার্ভিসেস লিমিটেড’র মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংকে জনবল সরবরাহ করতেন আরিকুল। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে আইএফআইসি ব্যাংকের এমডি হিসেবে যোগ দেন শাহ আলম সারোয়ার। তখন থেকেই এই ব্যাংকের জনবল সরবরাহের কাজ করতেন আরিকুল ইসলাম।
আরিকুল ইসলামের রেফারেন্সে সহজেই ব্যাংকে চাকরি হতো প্রার্থীদের। এজন্য অবশ্য সালমান এফ রহমান ও শাহ আলম সারোয়ারসহ অনেকের নানা চাহিদা মেটাতে হতো। ঢাকার বিমানবন্দর রোড ও বনানীর পাঁচ তারকা দু’টি হোটেলে প্রায়ই আসর বসতো শাহ আলমদের। এসব পার্টিতে আরিকুলের মাধ্যমে অংশ নিতেন সুন্দরী তরুণীরা। তারা মূলত চাকরি প্রার্থী। আরিকুল ইসলামের ব্যবসায় সম্পৃক্ত উল্লেখযোগ্য ব্যাংকগুলো হচ্ছে, আইএফআইসি ব্যাংক, দ্য সিটি ব্যাংক ও ইউসিবিল ব্যাংক।
নারী সাপ্লাই ছাড়াও ব্যবসার জন্য বিভিন্ন ব্যাংকের এমডি ও চেয়ারম্যানের অবৈধভাবে উপার্জিত টাকা বিদেশে পাচারে সহযোগিতা করেছেন আরিকুল ইসলাম। এসব কর্তাদের মনোরঞ্জনের জন্যই চাকরিপ্রত্যাশী বিভিন্ন অসহায় মেয়েদের ব্যবহার করতো ওই চক্র। চাকরির পর সুন্দরী কর্মীরা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হতেন আইএফআইসি ব্যাংকের তৎকালীন এমডি শাহ আলম সারোয়ার চক্রের। অনেকেই বাধ্য হতেন এই চক্রর অসৎ উদ্দেশ্যের কাছে মাথানত করতে। কথিত রয়েছে, পদোন্নতি বা ভালো ডেস্কে কাজ করতে চাইলে এর বিকল্প ছিল না। রাতারাতি পদোন্নতি জুটতো শাহ সারোয়ারের সুনজরে থাকলে।
এরকমই একজন আইএফআইসি ব্যাংকের প্রিন্সিপাল বাঞ্চের জনৈক নারী কর্মকর্তা। অন্যান্য সহকর্মীরা যখন যোগ্যতা থাকার পরও চাকরি হারান, তখন তার ক্ষেত্রে ঘটে উল্টো। তিনি গত ছয় বছরে ছয়টি পদোন্নতি পেয়েছেন। শুরু থেকেই কাজ করছেন একই ডেস্কে। কথিত আছে, একান্তে সময় না কাটালে সাধারণত কাউকে পদোন্নতি দিতেন না শাহ আলম সারোয়ার। ব্যাংকে চার স্তরের নিরাপত্তা পেরিয়ে সারোয়ারের কক্ষ। পাশেই দু’টি রেস্টরুম। সেখানেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাংকে কর্মরত নারীদের নিয়ে আড্ডা দিতেন সারোয়ার। শাহ আলম সারোয়ারের বাড়ি কুমিল্লায়। প্রতি সপ্তাহে তিনি সেখানে যেতেন। তখন কুমিল্লার নুরজাহান হোটেলে আসর জমাতেন সারোয়ার।
শাহ আলম সারোয়ারের কারণে আইএফআইসি ব্যাংক থেকে চাকরি হারাতে হয়েছে প্রায় দেড় সহস্রাধিক মানুষকে। এরমধ্যে করোনাকালে চাকরিচ্যুত করা হয় ৫২৮ জনকে। তারা ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে প্রায় ৩ হাজার জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, নিয়োগের ক্ষেত্রে ট্রেইনি সার্ভিস অফিসার থেকে ট্রানজেকশন সার্ভিস অফিসারসহ বিভিন্ন পদে ৬-১০ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়া হয়েছে।
সুন্দরী নারীদের ক্ষেত্রে ভিন্ন শর্ত থাকতো। অন্যদিকে, ভিন্নমতের কেউ ব্যাংকে রয়েছেন- এমন তথ্যপ্রমাণ পেলেই চাকরিচ্যুত করা হতো তাকে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে চাকরিচ্যুত করা হয় আইএফআইসি ব্যাংকের কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেনকে। তাকে ডেকে নিয়ে রিজাইন দিতে বাধ্য করা হয়। দেলোয়ার দ্য নিউজকে বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে এইচআর-এ সংযুক্ত করে শাস্তি দিতে থাকে। দেশের বিভিন্ন শাখায় কয়েক দিন করে ডিউটি করানো হয়। তাও জুনিয়দের অধীনে। যাতে বাধ্য হয়ে চাকরি ছেড়ে দেই। শেষ পর্যন্ত রুমে আটকে রেখে ভয়ভীতি দেখিয়ে রিজাইন দিতে বাধ্য করা হয়।
সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকের ১২শ’ উপ শাখায় ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কাজ করেছেন আরিকুল ইসলাম ও সারোয়ারের স্ত্রীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। অবৈধ উপায়ে অর্জিত টাকায় প্রায়ই বিদেশে বেড়াতে যেতেন শাহ আলম সারোয়ার ও তার স্ত্রী। তার বিদেশ সফরের কারণেই লাগাম টানতে বাধ্য হয়েছিলো বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৯ সালে বছরের ৪ মাসই বিদেশে কাটিয়েছিলেন তিনি। ওই বছর ২১ বার বিদেশ যান সারোয়ার। এক পর্যায়ে বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে এলে ২০২০ সালের ২৩ মার্চ সামগ্রিক ব্যাংক খাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের বিদেশ সফরের লাগাম টানতে সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। শাহ আলম সারোয়ার সবচেয়ে বেশি যাওয়া-আসা করতেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে চরম অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন সারোয়ার। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের পরিচালক, চুক্তিভিত্তিক উপদেষ্টা বা পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের একটি বিরতি দিতে বলা হয়। তা শাহ আলম সারওয়ারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়নি। তিনি গত ১৩ মে পর্যন্ত আইএফআইসি ব্যাংকের এমডি ছিলেন। তারপর সালমান এফ রহমানের আর্শীবাদে তিনি এমডি’র দায়িত্ব শেষ হতে না হতেই উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান। প্রতিমাসে বেতন অনুমোদন করা হয়েছিলো প্রায় ১৫ লাখ টাকা। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপর তিনি পদত্যাগ করে ব্যাংক ছাড়েন। এমডি থাকাকালীন সালমান এফ রহমানের নামে-বেনামে বিপুল অঙ্কের বিভিন্ন লোন অনুমোদন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এভাবেই দুর্নীতি করে ব্যাংকটির ব্যাপক ক্ষতি করেছে চক্রটি।
প্রথম প্রজন্মের ব্যাংক হিসেবে আইএফআইসি ব্যাংক দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ১৯৮৬ সালে। এই ব্যাংকের মোট শেয়ারের ৩২ দশমিক ৭৫ শতাংশই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন। অবশিষ্ট শেয়ারের মধ্যে ৩৯ দশমিক ১৯ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের, শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের, ২১ দশমিক শূন্য আট শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে এবং উদ্যোক্তাদের কাছে রয়েছে ছয় দশমিক ১৪ শতাংশ।
এ বিষয়ে শাহ আলম সারোয়ার ও আরিকুল ইসলাম পিন্টুর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর থেকে শাহ আলম সারোয়ারকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর মুখোশ ও ভোল পাল্টানোর চেষ্টা করছেন আরিকুল ইসলাম। বিএনপির বড় বড় নেতাদের নাম উল্লেখ করে তাদের সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে এমন তথ্য প্রচার করে নতুন করে তৎপরতা শুরু করেছেন। ভুক্তভোগীরা জানান, শাহ আলম সারোয়ার ও আরিকুল ইসলামের বিষয়ে তদন্ত করলে অনেক তথ্যই বেরিয়ে আসবে। বিশেষ করে রাঘব বোয়ালদের অর্থ পাচারের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে বলে তারা মনে করেন।
Tags: নারীর