আহমাদুল্লাহ আল জামি:
জিলহজের প্রথম দশ দিন মুমিনের জন্য আল্লাহর বিশেষ উপহার। এই দশ দিনের আমল আল্লাহর কাছে বছরের অন্যান্য দিনের আমলের চেয়ে অধিক পছন্দনীয়।
করোনার এই দুর্যোগকালে নির্ভয় ও নিঃসংকোচে মসজিদে বা ঈদগাহে গমন করে আমরা যখন আল্লাহর দরবারে হৃদয় উজাড় করে ইবাদতে নিমগ্ন থাকতে পারছি না।
এছাড়াও হজের মতো মহান ইবাদতেও যখন আমরা স্বতস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে পারিনি, তখন আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে এমন কিছু সুযোগ দিয়েছেন যে, চাইলেই আমরা ঘরে থেকেও আমলের মাধ্যমে বিপুল নেকি অর্জন করতে পারি।
বরকতপূর্ণ সময়গুলো কাজে লাগিয়ে আমরা আল্লাহর নৈকট্যশীল বান্দা হতে পারি। তেমনই একটি বরকতপূর্ণ সময় আমরা এখন যাপন করছি; কোন কোন বর্ণনায় যাকে মাহে রমজান থেকেও বরকতময় সময় বলা হয়েছে।
আর সে সময়টাই হচ্ছে জিলহজের প্রথম দশক। এই দশ দিনের গুরুত্ব নিয়ে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অসংখ্য হাদিস বিবৃত হয়েছে।
কোরআন ও হাদিসের বর্ণনায় এসেছে এই সময়ের বিশেষ কিছু আমলের কথাও। ‘তাকবিরে তাশরিক’ সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি আমল।
তাকবিরে তাশরিক নিয়ে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন- তোমরা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহকে স্মরণ কর। (সূরা বাকারা: ২০৩)
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এখানে নির্দিষ্ট দিনগুলো দ্বারা উদ্দেশ্য-তাকবিরে তাশরিক পাঠের দিনসমূহ। ( সহীহ বুখারী, মারিফাতুস সুনানি ওয়াল আছার, হাদিস ১০৮৭২)
তাকবিরে তাশরিক পাঠের তাৎপর্য কী?
তাকবিরে তাশরিকের তাৎপর্য হলো- আল্লাহতায়ালার জিকির এবং তাওহিদের চেতনায় সর্বদা উজ্জীবিত থাকা এবং শিরকের পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত তাওহিদের শিক্ষায় উদ্ভাসিত ঈমানী জীবন গঠনের লক্ষ্যে সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করা।
কারণ দ্বীন-ধর্ম ও আমল আখলাক সবকিছুর মূল হল, নির্ভেজাল তাওহিদ। এই বিশ্বাসে খুঁত থাকলে পর্বতসম আমলেরও কোনো মূল্য নেই।
তাই মুমিনের দিলে তাওহিদের শিক্ষাকে আরো মজবুত আরো শাণিত করতেই এই দিনগুলোতে অধিক পরিমাণে আল্লাহর জিকির করতে বারবার তাগিদ দেয়া হয়েছে।
শ্রদ্ধা, ভক্তি ও বিশ্বাসের সবটুকু মিশিয়ে মুমিন বলবে- আল্লাহু আকবার ওয়াহদাকা লা-শারীকা লাকা।
বিশেষ করে এই দিনগুলোতে আল্লাহর জিকিরের প্রতি আলাদাভাবে গুরুত্ব দেয়ার কারণ সম্পর্কে মুহাদ্দিস আল্লামা খাত্তাবী (রহ.) বলেন- বর্বরতার যুগে লোকেরা তাদের কথিত প্রভুদের নামে পশু-প্রাণী উৎসর্গ করত। এর প্রতি উত্তরে মুমিনদের প্রতি আদেশ করা হয়েছে তারা যেন আল্লাহর জিকির ও তাকবিরের মাধ্যমে তাওহিদ ও আনুগত্যের ঘোষণা প্রদান করে।
আল্লাহই একমাত্র ইলাহ। তার কোনো শরীক নেই। তিনি ছাড়া কারো নামে প্রাণী উৎসর্গ করা যাবে না। কারণ তা সুস্পষ্ট শিরক। (ফাতহুল বারী ২/৫৩৫)
তাকবিরে তাশরিক কী?
তাকবিরে তাশরিকের মূল কথা হলো- আল্লাহর জিকির তথা তার বড়ত্ব প্রকাশ করা। তবে,বিশেষ দিনে এই আমলের জন্য বিভিন্ন শব্দ হাদিসে উল্লেখিত হয়েছে।
হাদিস বিশারদদের মতে সর্বোত্তম ও সর্বজনবিদিত শব্দ হলো- আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওলিল্লাহিল হামদ। (তাবারানী মুজামে কাবীর: হাদিস: ৯৫৩৮, মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা: হাদিস: ৫৬৭৯)
তাকবিরে তাশরিক আদায়ের পদ্ধতি।
৯ ই জিলহজ ফজরের নামাজ হতে ১৩ ই জিলহজ আসর পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্তের ফরজ নামাজের পর কোন কথা বা সুন্নত নামাজ না পড়ে একবার করে তাকবিরে তাশরিক বলা ওয়াজিব।
জামাতে নামাজ পড়া হোক বা একাকি, পুরুষ বা নারী, মুকীম বা মুসাফির সকলের উপর ওয়াজিব।
(এবছর এই আমল আমরা শুক্রবার ফজরের নামাজ থেকে পরবর্তী মঙ্গলবার আসরের নামাজসহ প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর সমস্বরে আদায় করব ইনশাআল্লাহ)
তাকবিরে তাশরিক পুরুষের জন্য জোরে পড়া ওয়াজিব। আস্তে পড়লে তাকবীরে তাশরীক পড়ার হক আদায় হবে না। আর মহিলারা নিচু আওয়াজে অর্থাৎ নিজে শুনতে পায় এমন আওয়াজে পড়বে।
শুধু পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর তাকবিরে তাশরিক পড়তে হবে। বিতরের পর এবং অন্য কোনো সুন্নত বা নফলের পরে পড়ার নিয়ম সুন্নাহসম্মত নয়।
ইমাম তাকবির বলতে ভুলে গেলে মুক্তাদীরা ইমামের জন্য অপেক্ষা না করে নিজেরা তাকবির বলবেন।
কোনো সময় সকলেই বা কেউ কেউ তাকবির বলতে ভুলে গিয়ে মসজিদ থেকে বের না হয়ে গেলে তাকবির আদায় করে নিবে। আর যদি মসজিদ থেকে বের হয়ে যায় তাহলে এই ওয়াজিব ছুটে যাবে। এই ওয়াজিবের কোনো কাজা নেই এবং ওয়াজিব ছেড়ে দেয়ার কারণে ওই ব্যক্তি গুনাহগার হবে।
কোনো ব্যক্তির জামাত ছুটে গেলে ইমাম সাহেব সালাম ফিরানোর পর দাঁড়িয়ে স্বীয় নামাজ আদায় করার পর তাকবিরে তাশরিক বলবে।
৯ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত কোনো নামায কাজা হয়ে গেলে এবং ঐ কাজা এই দিনগুলোর ভিতরেই আদায় করলে সে কাজা নামাযের পরও তাকবিরে তাশরিক পড়বে।
হাজীদের ওপর ইহরাম অবস্থায় পূর্বোক্ত নিয়ম অনুযায়ী তাকবিরে তাশরিক পড়া ওয়াজিব।
ঈদুল আজহায় ঈদগাহে পৌঁছার আগ পর্যন্ত পথে পথে উচ্চস্বরে তাকবীর বলে বলে যাবে। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা: হাদিস ১৯২)
ঈদের দিন সাহাবায়ে কেরামের তাকবির ধ্বনিতে পুরো আশপাশ কেঁপে উঠত। আর এই তাকবির উচ্চ স্বরে বলার তাৎপর্য এটাও যে, এর দ্বারা ইসলামের তাওহিদের ঘোষণা প্রকাশ্যে উচ্চস্বরে দেওয়া হবে। গুনগুন শব্দে এর বহিঃপ্রকাশ কি সম্ভব? (ইসলাহী খুতবাত ২/১২৬-১২৯)
সার্বক্ষণিক জিকির ও তাকবিরের আমল ছাড়াও জিলহজের প্রাথমিক দিনগুলোর প্রায় প্রতিটি ইবাদত ও আমলের সাথে জিকির ও তাকবিরকে এমনভাবে জুড়ে দেয়া হয়েছে যেন সব আমল-ইবাদতের মূল কথা হল জিকরুল্লাহ, তাকবির ও তাওহিদ।
এজন্য এ সময়ের সকল ইবাদতের পরতে পরতে রয়েছে নির্ভেজাল তাওহিদের উপস্থিতি।
সাহাবায়ে কেরাম এই দিনগুলোতে সর্বদা আল্লাহু আকবারের ধ্বনি তুলতেন।
হযরত ইবনে উমর রা. ও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বাজারে গিয়ে তাকবিরের আওয়াজ তুলতেন। শুনে শুনে লোকেরাও তাদের সাথে তাকবিরের সুর তুলত।
ইবনে ওমর রা. পথে-ঘাটে, বাজারে-ঘরে এবং নামাযের পরে শুধুই তাকবির বলতে থাকতেন। মিনার দিনগুলোতো তার তাকবিরের সাথে সমস্বরে মানুষের তাকবিরে মিনার প্রাঙ্গন মুখরিত হয়ে উঠত। মহিলারাও (নিচু স্বরে) তাকবীর বলতে থাকতেন। (সহীহ বুখারী;ফাতহুল বারী ২/৫৩০-৫৩৬)
তাই আসুন,তাকবিরে তাশরিকের যে বাক্যজুড়ে রয়েছে তাওহিদ,আল্লাহর বড়ত্ব ও প্রশংসার কথা;সে বাক্যে উচ্চকিত করে তুলি পৃথিবীর প্রতিটি জনপদ।
এ জিকির গুঞ্জরিত হোক, প্রতিটি মসজিদে, প্রতিটি মুসলিমের ঘরে; প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর, নারী-পুরুষ সকলের মুখে।
তথ্যসূত্র: রদ্দুল মুহতার ২/১৭৭-১৮১; ফাতওয়া হিন্দিয়া ১/১৫২; আল বাহরুর রায়েক ২/১৬৪-১৬৫,ইলাউস সুনান ৮/১৪৮-১৬২;বাদায়েউস সানায়ে’ ১/৪৫৮-৪৬৫।