স্টাফ রিপোর্টার:
বছরের পর বছর গণপূর্ত অধিদপ্তরকে কুক্ষিগত করে রেখেছিল ‘ক্যাসিনো সম্রাট’ গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম ও তার সহযোগীরা। তাদের নেতৃত্বে গড়ে তোলা সিন্ডিকেট নানা অনিয়মের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্প থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ক্যাসিনো অভিযানের পর গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর নিকেতন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হয় গণপূর্ত সিন্ডিকেটের প্রধান জি কে শামীম।
তিনি গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের নাম। গণপূর্ত অধিদপ্তরের সেই সময়ের অতিরিক্ত প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলীসহ ১৩ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন দুদক।
তথ্য মতে, জি কে শামীম বর্তমানে জেলে থাকলেও তার ঘনিষ্ট সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত প্রকৌশলীরা এখনো গণপূর্তে সক্রিয়ভাবে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। জানা যায়, জি কে শামীম সিন্ডেকেটের অন্যতম সদস্য অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ কে এম সোহরাওয়ার্দী ও নিবার্হী প্রকৌশলী মোহাম্মদ শওকত উল্লাহসহ অনেকেই এখনো সক্রিয়ভাবেই তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। দুর্নীতি ও অনিয়মের বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণসহ দুদকে একের পর এক তাদের নামে বিভিন্ন অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এত অভিযোগের পরও তাদের বিরুদ্ধে আইনী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
দুদক ও গণপূর্ত অধিদপ্তর সুত্রে জানা যায়, কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে বড় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার অনিয়ম ও সরকারি অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অভিযোগের জন্য চলতি বছরের জানুয়ারিতে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন আহমেদকে তলব করেছিল দুদক।
জানা যায়, জি কে শামীম গ্রেপ্তারের পর তার সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে নাম আসে মোসলেহ উদ্দিন আহমেদের। ২০১৯ সালের ২০ নভেম্বর গণপূর্ত অধিদপ্তর কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারদের পক্ষে সোহেল রানা নামের একজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিনের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে দুদক প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগ জমা দেন। ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বরও দুদকে একই ধরনের অভিযোগ দায়ের করেছেন মো. বদরুদ্দীন ওমর নামের আরেক ব্যক্তি। তিনিও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিনের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির নানা রকমের অভিযোগ দেন। সর্বশেষ চলতি বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর আবারও নানা রকমের অভিযোগ তুলে প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিনের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ দাখিল করেন, গণপূর্ত ঠিকাদার সমিতির পক্ষে মো. মোশাররফ হোসেন নামের এক ব্যক্তি।
ওই অভিযোগে বলা হয়, ‘গণপূর্ত অধিদপ্তরের ঢাকা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন আহম্মেদের অনিয়ম ও সীমাহীন দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে গণপূর্তের সকল ঠিকাদার ব্যবসায়ী। পুরো অধিদপ্তরে তার পরিচিতি রয়েছে “ফিফটিন পার্সেন্ট” নামে। বর্তমানে প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়নে এই হারে কমিশন নিয়ে থাকেন তিনি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ও গণপূর্তমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতির কোনো তোয়াক্কা করেন না মোসলেহ উদ্দিন আহম্মেদ। ২০০২ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদ ভবনে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন মোসলেহ উদ্দিন। সেই সময় তহবিল তছরুপের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে এবং সংসদীয় কমিটির তদন্তেও অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। পরে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। কথিত যুবলীগ নেতা ও বিতর্কিত ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম (জি কে শামীম) সিন্ডিকেটের অন্যতম উপদেষ্টা হিসেবে পরিচিত এই মোসলেহ উদ্দিন।’
দুদকে জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, ‘বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে সংসদ ভবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দায়িত্ব পালন এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করা মোসলেহ উদ্দিন তার ব্যক্তি জীবনে গড়েছেন অঢেল সম্পদের পাহাড়। ঘুষ-দুর্নীতির টাকায় অস্ট্রেলিয়া, কানাডায় কিনেছেন আলিশান বাড়ি, ঢাকা ও কুমিল্লায় একাধিক বাড়ি, ফ্ল্যাট, বিলাসবহুল গাড়ি এবং বিপুল পরিমাণ অবৈধ্য সম্পদ রয়েছে তার।
বিসিএস ১৫তম ব্যাচের প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন ১৯৯৫ সালে গণপূর্ত অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী পদে যোগ দেন। এরপর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবে ঢাকা শেরেবাংলা নগরে দায়িত্ব পালন করেছেন। নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার পর শেরেবাংলা নগর ও দীর্ঘ সময় প্রধান প্রকৌশলীর স্টাফ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে সমন্বয় বিভাগে ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে চট্রগাম জোনেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সব জায়গাতেই তার দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।’
জানা যায়, গণপূর্তের জি কে শামীম সিন্ডিকেটের মূল উত্থান শুরু হয় অধিদপ্তরের সাবেক দুই প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম ও মো. সাহাদত হোসেনের হাত ধরে। মো. রফিকুল ইসলাম অবিভক্ত ঢাকা গণপূর্ত জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে কর্মরত থাকা অবস্থায় তার হাত ধরে জি কে শামীম সিন্ডিকেট ঢাকার গণপূর্ত অধিদপ্তরের সকল কাজ নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে। রফিকুল ইসলাম গণপূর্তের ঢাকা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসাবে যোগদানের সাথে সাথে তার স্টাফ অফিসার (নিবার্হী প্রকৌশলী) হিসাবে নিয়ে আসেন একেএম সোহরাওয়ার্দীকে। এরপর গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী পদটি পেয়ে যান রফিকুল ইসলাম। প্রধান প্রকৌশলী হওয়ার পর টেন্ডার নিয়ন্ত্রনের মহোৎসব শুরু করেন রফিকুল ইসলাম। নিয়োগ, বদলি বাণিজ্য, টেন্ডার, সরবরাহ, পদোন্নতি সব কিছুই এই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
পরবর্তীতে একেএম সোহরাওয়ার্দী জি কে শামীম সিন্ডিকেটের সহযোগিতায় পদোন্নতি নিয়ে গণপূর্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা সার্কেল-১-এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর দায়িত্ব পান। ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম চাকরি থেকে অবসরে গেলে জি কে শামীম সিন্ডিকেটের সহযোগিতায় মো. সাহাদত হোসেন প্রধান প্রকৌশলীর পদে বসেন। তার সহযোগিতায় একেএম সোহরাওয়ার্দী ঢাকার গণপূর্তের বিভিন্ন ডিভিশনে তার অনুগত নিবার্হী প্রকৌশলীদের পদায়ন, সিন্ডিকেটের টেন্ডার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। জি কে শামীম গ্রেপ্তারের পর গণপূর্ত অধিদপ্তরের যে কয়জন প্রকৌশলীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছিল দুদক, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন একেএম সোহরাওয়ার্দী।
২০১৯ সালে ৩১ ডিসেম্বর একেএম সোহরাওয়ার্দীকে তলবি নোটিশ পাঠায় দুদক। দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন স্বাক্ষরিত সেই নোটিশে চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়।
জানা যায়, জি কে শামীম সিন্ডিকেটের আরেক প্রভাবশালী সদস্য হচ্ছেন নগর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ শওকত উল্লাহ। বিসিএস ২৪তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই তৎকালীন এক মন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দিয়ে গণপূর্তে প্রভাব বিস্তার শুরু করেন।
সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, শওকত উল্লাহ একপর্যায়ে রফিকুল ইসলাম, মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ও একেএম সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে জি কে শামীম সিন্ডিকেটে প্রবেশ করেন। সিন্ডিকেটের সহযোগিতায় তিনি গত ১০ বছর ধরে ঢাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডিভিশনে একাধারে দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। এ ছাড়া জি কে শামীমের টেন্ডার অনুমোদনের সহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
জি কে শামীম গ্রেপ্তারের পর মোহাম্মদ শওকত উল্লাহকেও তলব করে দুদক। ২০১৯ সালের ৮ ডিসেম্বর দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন একই ধরনের নোটিশে ১১ জন প্রকৌশলীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
আলোচিত ঠিকাদার জি কে শামীম গ্রেপ্তারের পর গত ৩০ সেপ্টেম্বর তার ও তার সহযোগীদের সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। এরপর সংস্থার পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে সাত সদস্যের অনুসন্ধান দল কাজ শুরু করে। ২১ অক্টোবর দুদকের উপপরিচালক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন ঠিকাদার জি কে শামীমের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ের দায়ের হওয়া অভিযোগ এবং চলমান তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে দুদকের পরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘এই বিষয়ে আমি এখন তেমন কিছু বলতে পারবো না। বিস্তারিত পরে জানানো যাবে।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী কমকর্তারাকথা বলতে নারাজ। সর্বশেষে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল আলম সরাসরি অফিসে এসে কথা বলতে বলেন।