ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অভিন্ন ও অবিচ্ছেদ্য। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্বপ্ন ও আকাঙ্খা দীঘদিনের, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিল। যদিও এর পূর্বেই ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকায় প্রথম হরতাল পালিত হয়। ঢাকার আব্দুল গনি রোডে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল হয়। এই মিছিলে পুলিশের হামলায় অসংখ্য ছাত্র-জনতা আহত হয়। মিছিল থেকে শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৬৫জনকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে এই দাবিতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ছাত্র জনতাসহ সকল মহল থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি জোরালো হতে থাকে। তৎকালীন পাকিস্তানের গণপরিষদে কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত এমসিএ ধীরেন্দ্রনাথ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলা মহকুমা, থানা, এমনি অনেক মহল্লায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কমিটি গঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে জনতা সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ হয়। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভংগকরে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক মিছিল বের করলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালালে ঘটনা স্থলেই বরকত ও হাসপাতালে নেয়ার পথে সালাম, রফিক, জব্বার ও শফিক শাহাদাৎ বরন করেন। বিশ্বে মাতৃভাষা রক্ষার জন্যে এক মাত্র বাঙালি জাতিই রক্ত দিয়েছেন। ভাষা আন্দোলন মূলত বাঙালি জাতির শক্তি ও প্রেরণার উৎস। ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ গণমানুষের অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন ছিল। যার লক্ষ্য ছিল মানুষের মুক্তচিন্তা চেতনাসমৃদ্ধ শোষণহীন গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। যার ফলে মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান ও পুষ্টিসহ সকল মানবাধিকার নিশ্চিত হবে। ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পরেও আমরা দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে পারিনি। বাংলাদেশের সংবিধানে বলা আছে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। সাংবিধানিক ভাবে আমাদের রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন করার লক্ষ্যে আইন রয়েছে। প্রশাসনে বাংলা ভাষার ব্যবহার কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু আজও দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন করা সম্ভব হয়নি। আইনি পরিভাষার দোহাই দিয়ে উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা চালু হয়নি। তবে কয়েকজন সম্মানিত বিচারপতি বাংলা ভাষায় রায় দিয়ে প্রমান করেছেন যে, বাংলা ভাষায় রায় দেয়া যায়। আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার সিংহভাগে আমরা বাংলা ভাষা প্রচলন করতে পারিনি। বিশেষ করে চিকিৎসা শিক্ষা, প্রকৌশলী বিদ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা শতভাগ উপেক্ষিত। রাষ্ট্রের একটি ভাষানীতি ও ভাষা পরিকল্পনা এবং ভাষা সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ থাকা প্রয়োজন। আমাদের দেশের স্বাধীনতা ৫১ বছরেও এই সব হয়নি। ভাষা বিশেজ্ঞদের মতে অন্য ভাষা শিখতে বাধা নেই, তবে সেটা নিজের মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে নয়। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সমস্যগুলো চিহ্নিত করে, সমাধানের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যে দেশের মানুষের ভাষা বাংলা ও জাতিতে বাঙালি এবং বাংলা সংস্কৃতি যারা লালন করে, ভাষার জন্যে বিশ্বে একমাত্র যে জাতি রক্ত দিয়েছে সেই দেশে ৭১ বছরেও বাংলা ভাষা চালু না হওয়া খুবই দুঃখের বিষয়। বাংলা ভাষা বাঙালির হৃদয় অন্তরে ওতপোতভাবে মিশে আছে, কিন্তু পরিতাপের বিষয় বাংলা ভাষার নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা যথাযথ না থাকায় এবং ভিনদেশী সংস্কৃতি আগ্রাসনের কারণে বাঙালি নিজস্ব সংস্কৃতির যথাযথ বিকাশ ঘটছে না। ভাষা সংস্কৃতি ও ইতিহাস ঐতিহ্যে বাঙালি জাতি খুবই সমৃদ্ধশালী। ১৯১৩ সালে বাংলা ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গীতাঞ্জলী কাব্যের জন্যে নোবেল পুরস্কার পেয়ে বিশ্বের কাছে বাংলা ভাষাকে উজ্জল করেছে। জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে প্রত্যেকের মাতৃভাষা চর্চা বাড়াতে হবে, কারণ মাতৃভাষার মাধ্যমে নান্দনিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো যত দ্রুত সম্ভব অন্য কোন ভাষাতে তাহা সম্ভব নয়। প্রত্যেক মানুষের উচিত তার মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা করা এবং মাতৃভাষায় নিজস্ব জ্ঞান দক্ষতা অর্জন করা। দেশে জমজমাট পরিবেশে প্রতি বছর অমর একুশে বই মেলা এবং মাসব্যাপি পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানাদি গণমানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে পালিত হয়। সে দেশে অফিস আদালত, ব্যাংক বীমা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা এবং বাংলা সন-তারিখ উপেক্ষিত! এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ও সরকারের আরো সচেতন হওয়া দরকার। সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা চালু করতে সরকারসহ সকলকে সচেতন ও সচেষ্ট থাকতে হবে। ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে জাতিসংঘ একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করার মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে বাঙালির জাতির মর্যাদা সমুন্নত হয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের লক্ষ্য হচ্ছে প্রত্যেক মানুষের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধার জানানো এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠির ভাষা যেন হারিয়ে না যায় তা নিশ্চিত করা। বিশ্বের ৪ হাজার ভাষার মধ্যে প্রায় ৩ হাজার ভাষা ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে। অবশিষ্ট অধিকাংশ ভাষা বিলুপ্তির পথে। এ ক্ষেত্রে ভাষাগুলোকে সুরক্ষার জন্যে প্রত্যেক রাষ্ট্র ও সরকারের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা ও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন।
[লেখক পরিচিতি:
লায়ন মোঃ গনি মিয়া বাবুল
(শিক্ষক, গবেষক, কলাম লেখক ও সংগঠক)
সভাপতি, বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি]