শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন:
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে যতটা জল ঘোলা করা হয় তা বাংলাদেশের সাথে অন্য কোনো দেশের সম্পর্ক নিয়ে আদৌ হয়না। এই জল ঘোলাটা যে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্য আর চারপাশে ভারতের ভৌগলিক অবস্থানের বাইরেও আরো অনেক বিষয়ের ইংগিত বহন করে তা খোলাসা করে না বললেও সকলেই বুঝতে পারে।
এই সম্পর্ক নিয়ে সত্য, আংশিক সত্য, সম্পূর্ণ মিথ্যা বা মনগড়া তথ্যের ছড়াছড়িও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক দিক বিবেচনা করলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য ও কর্মসূচি থেকে সরকার ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন পক্ষের মতবাদ সহজেই অনুমেয়।
নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে সরকার বা সরকারবিরোধী বিভিন্ন দল/পক্ষের অবস্থান, বক্তব্য বা কর্মকান্ড থেকে সহজেই বিশ্লেষণ সম্ভব বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সমীকরণ। ভারত বিরোধী মনোভাব কি আসলেই বাংলাদেশের বৃহৎ স্বার্থকে প্রতিনিধিত্ব করে নাকি এটি আমাদের অসুস্থ রাজনৈতিক চর্চা বা ভৌগোলিক রাজনীতির আরেকটা দাবার চাল সেটাও গভীরে গিয়ে ভাবার বিষয়।
প্রতিবেশি দেশ হিসেবে এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশ ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক উষ্ণ সেটা অস্বীকারের সুযোগ নেই। বিভিন্ন ইস্যুতে আম নাগরিকদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন উঠলেও সেসকল ইস্যু কূটনৈতিকভাবে সমাধানের ক্ষেত্রে দুই দেশই ধৈর্য আর সহমর্মিতার পরিচয় দিয়েছে। দুই দেশের মাঝে সাক্ষরিত অসংখ্য চুক্তির মাঝে দেনা পাওনার হিসেব করলে আসলে হয়ত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুই দেশের পূর্ণ মনোভাবকে উপেক্ষা করা হবে। ভারত যেমন প্রতিবেশি হিসেবে বাংলাদেশকে বরাবর সব থেকে কাছের বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করেছে তবে অবশ্যই জাতীয় স্বার্থকে পাশ কাটায়নি ঠিক তেমনি বাংলাদেশও সমুদ্র সীমানার মত ইস্যুতে জাতীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়েছে। আবার ছিটমহল বিনিময়ের মধ্য দিয়ে দুই দেশ যে কূটনৈতিক সফলতার পরিচয় দিয়েছে তা প্রশংসার দাবিদার।
অভ্যন্তরিন রাজনীতি ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সবসময় হয়ত সম্পর্কের ফলাফল বাংলাদেশের পক্ষে আসেনি তবে চুক্তি বা সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করেছে বা ভারতকে যা চেয়েছে তাই দিয়েছে বিনিময়ে কিছুই পায়নি এমন ঢালাও অভিযোগের সুযোগ আসলে হয়ত নেই। বাংলাদেশের নাগরিকদের চিকিৎসা বা ভ্রমণের জন্য হরহামেসা ভারত ভ্রমণ কিংবা বাংলাদেশের প্রান্তিক পর্যায়েও ঘরে ঘরে ভারতীয় টেলিভিশনের তুমুল জনপ্রিয়তায় আসলে নিরূপণ করা কঠিন এদেশের বৃহৎ জনসংখ্যা ভারত বিরোধী মনোভাব পোষণ করে নাকি এটা আসলে কোনো পক্ষের প্রচারণা মাত্র।
ভারতীয় পণ্য বর্জন বা সম্পর্ক ছিন্ন করার মত বিভিন্ন কর্মসূচি নানা সময়ে সামাজিক মাধ্যমে দেখা গেলেও জনজীবনে কোনো রকমফের কখনোই পরিলক্ষিত হয়নি।
বরং ভারতীয় চিকিৎসা ব্যবস্থায় আস্থা বাড়ছে যা থেকে অনুমেয় যে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক জনজীবনে এমন কোনো বৈরি প্রভাব সৃষ্টি করেনি যা একজন সাধারণ নাগরিকের চিন্তার কারণ হতে পারে, ভিন্নভাবে বলা যায় জাতীয়ভাবে দেশব্যাপী ভারত বিরোধী মনোভাবের কোনো প্রকাশ নেই।খেয়াল করলেই দেখা যায়, বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের বিভিন্ন ইস্যুতে সোচ্চার। এক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লক্ষ করা যায় যে জামায়াত, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক কৌশলের একটি বড় ইস্যু ভারত।
এক্ষেত্রে ধর্মকে কেন্দ্র করে জামায়াত এবং সম্পর্কের অসমতাকে ইস্যু করে বিএনপিকে বক্তব্য ও কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা যায়। যদিও সম্প্রতি বিএনপিকে এই অবস্থান পাল্টে বরং ভারতের সাথে সমঝোতার পথে হাঁটতে দেখা যাচ্ছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। জামায়াত যেহেতু কখনোই সুস্থ ধারার রাজনীতি ও দেশের বৃহত্তর স্বার্থের সাথে যুক্ত নয় সেহেতু তাদের বক্তব্য বা অবস্থানকে অগ্রাহ্য করাই সমীচীন।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত বিদ্বেষী মনোভাব প্রচারের অগ্রনায়ক হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে নুরুল হক নুর। এখানে বিশ্লেষণের দাবী রাখে এই প্রচার কি আসলে যুক্তিযুক্ত কারণে নূরের দেশের পক্ষে অবস্থান নাকি কূটনৈতিক বিষয়াদি আমলে না নিয়ে শুধুমাত্র রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে সে এই পথ অবলম্বন করেছে। ধর্ষণ মামলার আসামী হিসেবে সে যেহেতু এখনো প্রমাণিত নয় সেহেতু তার ব্যক্তিগত নৈতিকতা বা দেশপ্রেম নিরূপণে আপাতত এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে গ্রহণ করা হচ্ছেনা।
কিন্তু এককভাবে দেশব্যাপী এই ধরণের একটি ক্যম্পেইন পরিচালনা, কোনো চাকুরি বা ব্যবসা না করেই ঢাকা শহরে পরিবার নিয়ে বসবাস ইত্যাদি স্পষ্টভাবেই প্রমাণ করে ভারত বিদ্বেষী এই প্রচারণায় নুর কুশীলবমাত্র। নুরকে সামনে রেখে এর পেছনে আরেকটি বড় দল বা পক্ষ অর্থায়ন, কর্মসূচি নিরূপণ ও কৌশল প্রনয়ণে কাজ করছে সেটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই তা সে পক্ষ ভালোই হোক বা খারাপ।
তবে আসিফ নজরুল, মাহমুদুর রহমান মান্না, ডা. কামাল এর মত ব্যক্তিরা যে সেই বিশেষ পক্ষের সাথে যুক্ত তা প্রমাণিত হয় ধর্ষণ মামলার রায়ের আগেই নুরের পক্ষে তাদের এহেন নির্লজ্জ সমর্থনে। রাজনৈতিক স্বার্থ ছাড়া নিরেপক্ষ অবস্থান থেকে যেকোনো অভিযোগের ক্ষেত্রে এমন নগ্ন একপাক্ষিক বক্তব্য অসম্ভবই বটে। পেছন থেকে যারা নুরের কাজ করছে তারা আসলে বাংলাদেশের পক্ষে না বিপক্ষে তা সিদ্ধান্তে আসার জন্য সেই পক্ষ কারা এবং তাদের উদ্দেশ্য জানা জরুরি।
আপাত দৃষ্টিতে এই ধরণের অর্থায়ন সম্ভব শুধুমাত্র চীনের পক্ষেই বলে ধারণা করা যায়। একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র মনে করছে, বাংলাদেশে ভারতবিদ্বেষী মনোভাব বাড়াতে আর্থিক যোগান সহ নানা রকম ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশেরই আরেক বন্ধুপ্রতীম দেশ চীন। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সাথে চীনের বৈরী সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারী বেসরকারি প্রকল্পে মোটা অংকের বিনিয়োগ এই ধারনাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে।
ভৌগলিকভাবেও ভারতকে কোনঠাসা করতে ভারতের সবথেকে কাছের বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র থেকে ভারতকে আলাদা করে ফেলা চীনের জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ইতোমধ্যে এই ধরণের কৌশল চীন অন্যান্য দেশে সফলভাবেই প্রয়োগ করেছে।
ভেবে দেখার মতো বিষয়, ভারতবিদ্বেষী কার্যক্রমে চীনের এই গোপন অর্থায়ন আমাদের জাতীয় স্বার্থকে তরান্বিত করবে কি? ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি আমাদের জন্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ভৌগলিক কোনোভাবে লাভজনক কিনা সেটার স্বরূপ নির্ধারণ জরুরী।
যদিও বাংলাদেশ সরকার এখনো পর্যন্ত দুই পক্ষের সাথেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক সুচারুভাবে রক্ষা করে চলেছে তবে গোপনে অর্থায়ন, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি ইত্যাদি অনাকাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপে এই অবস্থার পরিবর্তন হলে তা আমাদের জন্য মোটেও সুখকর হবেনা।
সামগ্রিক জনমত বিবেচনায় এটি প্রমাণিত হয় ভারতবিদ্বেষী মনোভাব বাংলাদেশে কোনো জাতীয় দাবী বা জাতীয় ঐক্য নয় বরং কোনো স্বার্থরক্ষায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছড়িয়ে দেয়া একটি রাজনৈতিক কৌশলমাত্র। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ সরকারের উচিত ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের সুচারু ধারা অব্যাহত রাখা এবং জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে দ্বিপাক্ষিক সিদ্ধান্তগুলোতে নিজেদের অবস্থান জনগণের কাছে স্পষ্ট করা।
লেখক পরিচিতি-
শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন, পেশায় রাজনীতি ও প্রযুক্তি ব্যবসায়ী। জাপানের রিতসুমেকিন এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপ অর্জনকারী। বাংলাদেশের প্রথম ইলেকট্রো ম্যানুফেকচারিং সার্ভিসেস কোম্পানি সেলট্রন ইএমএস’র প্রতিষ্ঠাতা।