বাবা নাসিম আবদুল্লাহ ও মা রূপা খানমের সঙ্গে নাফীকরোনাভাইরাসের কারণে লকডাউনের মধ্যে আমাকে কাজ করতে হচ্ছে দুই ধরনের স্কুলের সঙ্গে। আমি পেশায় একটি পাবলিক স্কুলের সহকারী শিক্ষিকা। করোনার কারণে স্কুলে যাওয়া সম্ভব না। কিন্তু পড়াশোনা বন্ধ রাখা যাবে না। করোনার কারণে স্কুলের অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষকদের শিক্ষা কারিকুলাম দেওয়া হচ্ছে। সব ছাত্রছাত্রী তা পড়ে কমপ্লিট করে তাদের লেখা, প্রজেক্ট ও ধার্যকরণ করে। রিমোট লার্নিং হলেও পড়ালেখা নিয়মিত চলছে। আমি নিজের স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য করি গুগল ক্লাস রুমের মাধ্যমে।
সেই সঙ্গে আমার ছেলের স্পেশাল স্কুলের কাজ। প্রতি থেরাপির সেশন, দুই ধরনের স্কুল—সব মিলিয়ে যেন হিম শিম খাই। আগে ঘর থেকে বের হয়ে নির্দিষ্ট সময় কাজ করে ঘরে এসে ঘরের কাজে মনোযোগ দিতাম। এখন ঘরের বাইরের সব কাজ একসঙ্গে করতে হয়, যেন রোবট জীবনে পরিণত হয়ে গেছে। মানুষের জীবনে অনেক দরকার হয় না, এই বিষয়টি এখন যেন বুঝে গেছি। যত বড় অট্টালিকা আর ব্যাংকে যত টাকা থাকুক, কিছুই যেন মানুষের কাজে আসে না। মানুষের সবচেয়ে দরকার সুস্থতা, থাকার জায়গা আর খাবার।
আমার সতেরো বছর বয়সী ছেলে একজন অটিস্টিক কিশোর। সে তার বয়সী সাধারণ ছেলেমেয়েদের মতো নিজের হোম ওয়ার্ক নিজে করতে পারে না। তাকে সম্পূর্ণভাবে আমার পড়াতে হয়। ছেলের প্রতি থেরাপির সেশনে থাকতে হয়।
আগে বাসা থেকে বের হয়ে নির্দিষ্ট সময় কাজ করে বাসায় এসে ঘরের কাজে মনোযোগ দিতাম। এখন যেন ঘরে-বাইরে সব কাজ এক সঙ্গে বাসায়। এ যেন রোবট জীবনে পরিণত হয়ে গেছে। ঘরের সময় আর কাজের সময় বলে আলাদা কিছু নাই। আমার একমাত্র সন্তান নাফীর বর্তমান বয়স ১৭ বছর, ও এখন নিজের খাবার নিজে খেতে পারে, টয়লেট ও গোসল নিজে নিজে করতে পারে। আমি সব শিখিয়েছি। তবে আমাদের বাঙালি খাবার খেতে চায় না। যেমন মাছ, ভাত, তরকারি—এসব আমাকে হাত দিয়ে মেখে খাইয়ে দিতে হয়। লকডাউনের আগে ছেলের জন্য বাসায় নিয়মিত হোম অ্যাটেনডেন্ট পেতাম। সে নাফীর অনেক কাজ করে দিত। ওর অ্যাপ্লাইড বিহেভিয়র টিচার আসত, সেও নাফীকে পড়াত। কিন্তু গত তিন মাস ধরে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বাইরের যে কেউ বাসায় আসা বন্ধ। সব কাজ তাই নিজেকে করতে হয়। পাশাপাশি নাফীকে প্রতিদিন ট্রেডমিল করাই আধ ঘণ্টা। আগে স্কুলে জিমে নিয়মিত ঘাম ঝরাতো। যেটা অব্যাহত রাখতে চাই বাসাতে।
করোনার ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি। তাই আমি মনে করি, সব সময় কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। করোনার সঙ্গে কীভাবে তাল মিলিয়ে চলা যায়, তার চেষ্টা করা জরুরি। প্রত্যেককেই পরিবারে রুটিন করে চলা, কাজ ভাগ করে নেওয়া, পরিবারের ছোটদের গুরুত্ব দেওয়া, যৌথ পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে বসে পুরোনো দিনের গল্প করা, সবাই মিলে ছবি দেখা ইত্যাদি একসঙ্গে করা। যারা ছবি আঁকা পছন্দ করে, তারা সেটা করলে ভালো করতে পারে। কেউ চাইলে গান শুনতে পারেন, বাগান করতে পারেন। আমি নিজে বাড়ির পেছনে সবজি গাছ করেছি। সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি আমার পরিবার, গাছগুলো দেখে কী যে ভালো লাগে।
করোনায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও ঘরে বসে চেষ্টা করতে হবে নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে ব্যস্ত রাখার। এরই মধ্যে ঈদ এল। আগের চেয়ে পরিবার, আত্মীয়-বন্ধু এবং প্রতিবেশী সবার সঙ্গে সময় দিয়েছি, ওয়েব ক্যামেরায় কৌশল বিনিময় আগের থেকে বেশি সময় নিয়েছি। ঈদের আনন্দ ঘরেই বসে অনুভব করলাম। আমার কাছে আরও বেশি হ্রদয়গ্রাহী মনে হয়েছে। সব সময় ঘর থেকে বের হতে হলে মুখে মাস্ক আর হাতে গ্লোব, দূরত্ব বজায় রেখে নিয়ম মেনে সবকিছুই করা সম্ভব। নতুন পৃথিবীতে যদি বেঁচে থাকতে পারি, যেন মানুষ হয়ে বেঁচে থাকি, আমরা দানব যাতে না হই। আশা করি, সবাই মিলে গড়ে তুলব নতুন সুন্দর এক মানবিকতার পৃথিবী। সব শেষে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত সেই কবিতা মনে পড়ছে, ‘বিপদে মেরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা। বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’